২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৬:১৫

রমজানে যে ভুলগুলো করে থাকি আমরা

ধর্ম ডেস্ক :

নানা সীমাবদ্ধতার কারণে পবিত্র মাহে রমজান অনেক ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। এটা মুসলিম হিসেবে আমাদের জন্য মোটেও গৌরবের বিষয় নয়। আসুন পবিত্র রমজানে আমাদের করা ভুলগুলো সম্পর্কে জানি এবং সচেতন হই।

১. রমজানকে প্রথাগত অনুষ্ঠান মনে করা: আমাদের অনেকের কাছে রামাদান তাঁর আধ্যাত্মিকতা হারিয়ে ইবাদাতের বদলে একটি প্রথাগত অনুষ্ঠানের রূপ লাভ করেছে। আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ‘zombie’র মত উপোস থাকি শুধুমাত্র আমাদের আশেপাশের সবাই রোজা রাখে বলে। আমরা দু’আ করতে ভুলে যাই, ভুলে যাই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে এবং জাহান্নামের আগুন থেকে আমাদেরকে মুক্তি দান করতে। নিশ্চিতভাবে আমরা পানাহার থেকে বিরত থাকি কিন্তু সেটা কেবল লৌকিকভাবেই!

যদিও আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘জিবরাঈল (আ.) আমাকে বলেছেন, আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তির নাক মাটিতে ঘষুন যার নিকট রামাদান আসল এবং তার গুনাহসমূহ মাফ হল না, এবং আমি বললাম, আমিন। তারপর তিনি বললেন, আল্লাহ ঐ ব্যক্তির নাকও মাটিতে ঘষুন যে জীবদ্দশায় তার পিতামাতার একজনকে অথবা উভয়কে বৃদ্ধ হতে দেখল এবং সে জান্নাতে প্রবেশ করার অধিকার রাখল না তাদের সেবা করার মাধ্যমে আর আমি বললাম, আমিন।

অতঃপর তিনি বললেন, আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তির নাক মাটিতে ঘষুন যার উপস্থিতিতে যখন আপনার নাম উচ্চারণ করা হয় তখন সে আপনার প্রতি সালাম বর্ষণ করে না আর আমি বললাম, আমিন।’(তিরমিযী, আহমাদ)

২. পানাহারের ব্যাপারে অতিমাত্রায় চাপে থাকা: আমাদের অনেকের ক্ষেত্রে, রামাদান মাসের পুরোটাই খাবার ঘিরে আবর্তিত হয়। সালাত, কুরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদাতের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া বদলে আমরা পুরোটা দিন কেবল পরিকল্পনা প্রণয়ন, রান্নাবান্না, কেনাকাটা এবং খাওয়া-দাওয়া নিয়ে চিন্তা করে কাটাই। আমাদের চিন্তা ভাবনার পুরোটা জুড়েই থাকে ‘খাওয়া-দাওয়া’।যার দরূন আমরা উপোস থাকার মাসকে ভোজের মাসে পরিণত করেছি। ইফতারের সময়ে আমাদের টেবিলের অবস্থা দেখার মত!

৩. সারা দিন রান্না করে কাটানো: কতিপয় বোন (হয় স্বেচ্ছায় নতুবা স্বামীর চাপে) সারা দিন ও সারা রাত ধরে রান্নাবান্না করতে থাকেন, তার ফলে দিনের শেষে তারা এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েন যে এশার সালাত পড়তে পারেন না, তাহাজ্জুদ কিংবা কুরআন তিলাওয়াত তো দূরে থাক! এই মাস হল মাগফিরাত এবং মুক্তিপ্রাপ্তির মাস। সুতরাং, চলুন আমরা চুলা বন্ধ করে নিজেদের ঈমানের প্রতি মনযোগী হই।

৪. মাত্রাতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়া: আমাদের কেউ কেউ সেহরীর সময়ে নিজেদেরকে বিস্ফোরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ভারাক্রান্ত করে তুলি, কারণ আমরা মনে করি সারা দিন ক্ষুধার্ত অনুভব না করার এটাই একমাত্র পথ, আর কিছুসংখ্যক রয়েছেন যারা ইফতারের সময় এমনভাবে খান যাতে মনে হয় আগামীকাল বলে কিছুই নেই, সারাদিন না খাওয়ার অভাব একবারেই মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। যাহোক, এটা সম্পূর্ণরূপে সুন্নাহ্ বিরোধী কাজ।

৫. সারাদিন ঘুমিয়ে কাটানো: আমাদের চেষ্টা করা উচিত এই পবিত্র মাসের প্রতিটি মূহুর্ত আল্লাহর ইবাদাতে কাটানোর, যাতে করে আমরা এই মাসের সর্বোচ্চ সওয়াব হাসিল করতে পারি। অথচ আমাদের কেউ কেউ সারাদিন ঘুমিয়ে, ভিডিও গেমস্ খেলে অতিবাহিত করে, অথবা টিভি বা ছবি দেখা এমনকি গান শুনে পার করে দেই।

৬. রোজা রাখা অথচ খারাপ কাজ বর্জন না করা: আমাদের কিছু সংখ্যক রোজা রাখে কিন্তু তারা মিথ্যাচার, অভিশাপপ্রদান, মারামারি, গীবত ইত্যাদি বর্জন করে না এবং কিছুসংখ্যক রোজা রাখার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র পানাহার থেকে বিরত নয় বরং আল্লাহর প্রতি তাকওয়া(পরহেজগারী) অর্জন অনুধাবন না করে রোজা রাখে কিন্তু তারা প্রতারণা, চুরি, হারাম চুক্তি সম্পাদন, লটারির টিকেট ক্রয়, মদ বিক্রি, যিনা ইত্যাদিসহ যাবতীয় অননুমোদিত কর্মকাণ্ড বর্জন করে না।

৭. ধূমপান: ধূমপান ইসলামে বর্জনীয় সেটা রামাদান মাসেই হোক বা এর বাইরে হোক, কারণ এটা “আল-খাবিছ্’(খারাপ কাজ) এর একটি। এবং এটা যাবতীয় ধূমপানের সামগ্রী অন্তর্ভুক্ত করে যেমন. সিগার, সিগারেট, পাইপ, শিশা, হুক্কা ইত্যাদি।

৮. ইচ্ছাকৃতভাবে সেহরি বাদ দেয়া: রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘সেহরি খাও, কারণ এটার মধ্যে বরকত রয়েছে।’(বুখারী, মুসলিম)। অথচ অধিক সময় রাত জাগার কারণে কেউ কেউ সেহেরি মিস করেন।

৯. ইমসাকের সময় সেহরি খাওয়া বন্ধ করে দেয়া: কিছু লোক রয়েছে যারা ফজরের ওয়াক্তের ১০-১৫ মিনিট পূর্বে ইমসাক পালনের জন্য সেহরি খাওয়া বন্ধ করে দেয়। শেখ ইবনে উছাইমিন বলেছেন: ‘এটা বিদ’আত ছাড়া আর কিছু নয় যার কোন ভিত্তি সুন্নাহে নেই। বরং সুন্নাহ হল তার উল্টোটা করা। আল্লাহ প্রত্যুষের আগ পর্যন্ত আমাদেরকে খেতে অনুমতি প্রদান করেছেন: ‘আর আহার কর ও পান কর যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কালো রেখা থেকে স্পষ্ট হয়।’ (সূরা বাকারা: ১৮৭)

১০. সেহরি না খাওয়ায় সাওম পালন না করা: আমাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক রয়েছে যারা সাওম পালন করে না এই ভয়ে যে সেহরি খাওয়া হয়নি। যাহোক, এটা এক ধরনের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ভালোবাসা ও কাপুরুষতা। এ আর এমন কি ব্যাপার যে সামান্য কয়েক মুঠো খাবার খাওয়া বাদ হয়ে যায়? এমন না যে এর কারণে আমরা মারা যাব। আমাদের মনে রাখতে হবে যে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য সবকিছুকেই ছাপিয়ে যায়।

১১. রোজা ভাঙতে দেরি করা: আমাদের অনেকেই ইফতারের সময় মাগরিবের আযান শেষ হওয়া পর্যন্ত বসে থাকেন, আযান শেষ হলে রোজা ভাঙেন। সূর্য অস্ত যাবার পর আজান দেয়ার সাথে সাথে রোজা ভাঙা সুন্নাহ সম্মত। আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটাই করতেন। (মুসলিম)

১২. ইফতার বেশি খেতে গিয়ে মাগরিবের নামাজের জামাত ধরতে না পারা:আমরা অনেকেই ইফতারিতে এত বেশি খাবার নিয়ে বসি যে সেগুলো শেষ করতে গিয়ে মাগরিবের জামাত ধরতে পারি না। এটা একেবারেই অনুচিত। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কয়েক টুকরা খেজুর মুখে দিয়ে ইফতার ভেঙে অতঃপর মাগরিবের নামাজ এর জন্য চলে যেতেন। নামাজ শেষ করে এসে আমরা ফিরে এসে ইচ্ছা করলে আরও কিছু খেতে পারি।

১৩. আমাদের দুআ কবুল হওয়ার সুযোগ ছেড়ে দেয়া: সিয়াম পালনকারী ব্যক্তির দুআ রোজা ভাঙার সময় আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে থাকে। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেন, ‘তিন ধরনের ব্যক্তির দুআ ফিরিয়ে দেয়া হয় না- ১) একজন পিতার দুআ, ২) রোজাদার ব্যক্তির দুআ, ৩) মুসাফিরের নামাজ। (বায়হাকি)। আমরা এই সময়ে দুআ না করে বরং খাবার পরিবেশন, কথাবার্তা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকি।

১৪. রোজা রাখা অথচ নামাজ না পরা: সিয়াম পালনকারী কোন ব্যক্তি নামাজ না পরলে তার সিয়াম কবুল হয় না। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘সালাত (নামাজ) হচ্ছে ঈমান এবং কুফর এর পার্থক্যকারী’। (মুসলিম)

১৫. রোজা রাখা অথচ হিজাব না পরা: মুসলিম নারীদের জন্য হিজাব না পরা কবীরা গুনাহ।

১৬. পরীক্ষা কিংবা কর্মব্যস্ততার জন্য রোজা না রাখা: পরীক্ষা কিংবা কর্মব্যস্ততার কারণে রোজা না রাখা শরীয়ত সম্মত নয়। সকালে পড়ালেখা করতে কষ্ট হলে রাতে করার সময় থাকে।

১৭. স্বাস্থ্য কমানোর উদ্দেশ্যে রোজা রাখা: স্বাস্থ্য কমানোর জন্য রোজা রাখা উচিত নয়। এটি অন্যতম একটি বড় ভুল যা আমরা করে থাকি। সিয়াম পালন করার একমাত্র উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। যদি স্বাস্থ্য কমানোর উদ্দ্যেশ্যে কেউ রোযা রাখে তাহলে তা শিরকের (ছোট শিরক বা শিরকুল আসগার) আকার ধারণ করতে পারে।

১৮. তারাবির নামাজের রাকাআত সংখ্যা নিয়ে মতবিরোধ: তারাবির নামাজের কোন নির্দিষ্ট সংখ্যক রাকাআত নেই। আট এবং বিশ রাকাআত-এ দুটোই শরীয়তসম্মত।

১৯. শুধু ২৭ রমজানের রাতকে লাইলাতুল ক্বাদর মনে করে ইবাদত করা: আমরা অনেকেই কেবল ২৭ রমজান রাতে লাইলাতুল ক্বাদর পাওয়ার জন্য ইবাদত করে থাকি, কিন্তু অন্যান্য বিজোড় রাতগুলিকে প্রাধান্য দেই না। অথচ রাসুল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন, ‘রমযানের শেষ দশ রাত্রির বিজোড় রাতগুলিতে লাইলাতুল ক্বাদর তালাশ কর।’(বুখারি ও মুসলিম)

২০. ঈদের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে রমজানের শেষাংশ অবহেলায় পালন করা: আমরা অনেকেই ঈদের প্রস্তুতি (নতুন কাপড় কেনা, খাবারের আয়োজন করা, মার্কেটে ঘোরাঘুরি করা) নিতে গিয়ে রমজানের শেষ দশ দিন অবহেলায় পালন করি (ঠিকমত ঈবাদত না করা এবং লাইলাতুল ক্বাদরের তালাশ না করা)। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমজানের শেষ দশ দিন আল্লাহর ইবাদতে খুব বেশি সময় নিমগ্ন থাকতেন, কেনাকাটি করায় ব্যস্ত থাকতেন না। রমজান শুরু হবার আগেই আমাদের কেনাকাটি শেষ করা উচিৎ।

২১. অহেতুক ইফতার পার্টির আয়োজন করা: যদিও অপরকে ইফতারি করানোতে সওয়াব আছে এবং এ কাজে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে, তথাপি আমাদের অনেকেই মুখরোচক ইফতার পার্টির আয়োজন করে থাকেন, যা জরুরি নয়।

দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :মে ২৫, ২০১৮ ১১:৩০ পূর্বাহ্ণ