الحمد لله رب العالمين. والصلاة والسلام علي رسوله الكريم. وعلي اله واصحابه اجمعين. اما بعد.
يا أَيُّهَا ٱلَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُون
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকীদের কল্যানের জন্য যেসব বিধান দিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো রমাদান বা শাহরু রমাদান। আর এই রমাদানে যে আমল গুলো করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো সাওম বা রোজা বা উপবাস। আরো অন্যান্য আমলও রয়েছে। আজ আমি আলোকপাত করবো রমাদান এর শিক্ষাগুলো নিয়ে।
আল কোরআনে রমাদান ও সাওম :
রমাদান( رمضان)শব্দটি এসেছে ১ বার। সুরা বাকারা : ১৮৫
আল কোরআনে সাওম শব্দটি দুই ভাবে এসেছে, যেমনঃ الصوم. الصيام.
. الصيام. শব্দটি এসেছে ৭ বার,সুরা বাকারাঃ১৮৩,১৮৭,১৯৬, সুরা নিসাঃ৯২,সুরা মায়েদাঃ৮৯,৯৫ সুরা মুজাদালাহ : ৪।
আর الصوم শব্দটি এসেছে ২ বার।সুরা বাকারাঃ১৮৪, সুরা মারিয়াম : ২৬
উপরোল্লিখিত আয়াত সমুহে আল্লাহ তায়ালা সাওম এর বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ।মজার বিষয় হলো অন্যান্য ইবাদাতের ব্যাপারে শুধু মুল বিষয়টা এসেছে কোরআনে কিন্তু সাওম এর বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বিশদ আলোচনা করেছেন। কেউ যদি সাওম এর বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চায় সে যেন প্রথমেই কোরআনে চোখ দেয়।তাছাড়া মুমিনের জীবনের প্রতিটি বিষয়ের মূল সমাধান তো কোরআনেই। তাই মুমিনরা যখনি কোনো সমস্যার সন্মুখীন হবে প্রথমেই সে কোরআনের দিকে ছুটবে।অবশ্যই সে তার সমাধান পাবে।
রমাদান এর পরিচয় :
রমজান শব্দটি আরবি। এর আভিধানিক অর্থ উত্তাপ, তাপাধিক্য, তাপের উচ্ছমাত্রা, দগ্ধ করা, তাপ দগ্ধ করে পুরিয়ে দেয়া। আর রমজানকে এসব অর্থে এজন্যই ব্যবহার করা হয়। রমজানের সিয়াম সাধনা, সিয়াম পালনকারীকে সবর ও সহিষ্ণুতা অগ্নি দহনে সংযমের উত্তাপে রিপুগুলো দগ্ধ করে কুপ্রবৃত্তি পুরিয়ে মানবাত্মাকে খাঁটি শুদ্ধ করে পরিশোধিত মানুষরূপে গড়ে তোলায় সহায়তা করে।
আল্লাহ নিজের সঙ্গে সিয়ামের সম্পর্ক ঘোষণা করেছেন।আল কোরআনে রমাদান শব্দটি যেভাবে এসেছে, ﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِ। রমযানের মাস, এ মাসেই কুরআন নাযিল করা হয়েছে , যা মানব জাতির জন্য পুরোপুরি হিদায়াত এবং এমন দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা সম্বলিত, যা সত্য –সঠিক পথ দেখায় এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়, সুরা বাকারাঃ ১৮৫।
সাওম এর পরিচয় :
আর সাওম বা সিয়াম। যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার এবং সেই সাথে যাবতীয ভোগ-বিলাস থেকেও বিরত থাকার নাম রোজা।
রমাদান এর গুরুত্ত ও ফজিলত :
আবু হুরাইরা রা থেকে বর্ণিত,রাসুল সঃ বলেছেন,সিয়াম ঢাল স্বরূপ। সুতরাং অশ্লীলতা করবেনা এবং র্মুখরে মত কাজ করবেনা। যদি কেও তার সাথে জগড়া করতে চায়,তাকে গালি দেয়,তবে সে যেন দুইবার বলে, আমি রোজা পালন করছি। ঐ সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের গন্ধের চাইতেও উত্তম।সে আমার জন্য আহার,পান ও কামাচার পরিত্যাগ করে। সিয়াম আমার জন্য। আর তাই এর পুরস্কার আমি নিজেই দেবো। আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশগুণ।
এমনিভাবে সব ইবাদত-বন্দেগি থেকে সিয়ামকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছেন মহান আল্লাহ-তাআলা। যেমন হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত, “তিনি বলেন, মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, কিš‘ সিয়াম তার ব্যতিক্রম, তা শুধু আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব”। (মুসলিম)
অন্যান্য সব ইবাদতের চেয়ে রমজানের রোজার গুরুত্ব অনেক বেশি। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, “তিনি রাসূলকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ), আমাকে অতি উত্তম কোনো নেক আমলের নির্দেশ দিন। রাসূল (সা.) বললেন, তুমি রোজা পালন করো। কারণ এর সমমর্যাদার কোনো আমল নেই”। (নাসাঈ)
“রোজা হলো ঢাল ও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার মজবুত দুর্গ”। (আহম্মদ)।
‘‘রমাদান- বরকতময় মাস তোমাদের দুয়ারে উপনিত হয়েছে। পুরো মাস রোযা পালন আল্লাহ তোমাদের জন্য ফরয করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। দুষ্ট শয়তানদের এ মাসে শৃংখলাবদ্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে আল্লাহ কর্তৃক একটি রাত প্রদত্ত হয়েছে, যা হাজার মাস থেকে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল, সে বঞ্চিত হল (মহা কল্যাণ হতে)’’ [সুনান আত-তিরমিযি: ৬৮৩] ‘‘এ মাসের প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী এ বলে আহবান করতে থাকে যে, হে কল্যাণের অনুসন্ধানকারী তুমি আরো অগ্রসর হও! হে অসৎ কাজের পথিক, তোমরা অন্যায় পথে চলা বন্ধ কর। (তুমি কি জান?) এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ তায়ালা কত লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন’’ [সুনান আত-তিরমিযী : ৬৮৪] রোযার ইতিহাস :
রোযার প্রাথমিক ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কোন কিছু জানা যায় না। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত দার্শনিক স্পেন্সার নিজের বইতে কতগুলো বন্য সম্প্রদাইয়রে উদাহরণ এবং জীব বৃত্তান্তের ওপর গবেষণা করে লিখেছেন যে, রোযার প্রাথমিক মানদন্ড এভাবেই হয়তো হয়ে থাকবে যে আদিম বন্য যুগের মানুষ স্বভাবতই ক্ষুৎ-পিপাসায় আক্রান্ত থাকতো এবং তারা মনে করতো যে, আমাদের আহার্য বস্তু আমাদের পরিবর্তে এই প্রক্রিযার মাধ্যমে মৃতদের নিকট পৌঁছে যায়। কিন্তু অনুমানসিদ্ধ উপাত্তকে যুক্তি ও বুদ্ধির আওতাভুক্ত লোকেরা কখনো স্বীকার করে নেয় নি।
মোট কথা অংশীবাদী ধর্মমতগুলোতে রোযার প্রারম্ভ এবং হাকীকতের যে কোন কারণেই হোক না কেন ইসলামের দৃষ্টিতে এর প্রাথমিক পর্যায় ও শেষ পর্যায়কে বিশ্লষেণ করার ক্ষেত্রে নিজের অনুসারীদের ওকালতির প্রতি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করে না। ইসলামের মূল উৎস কুরআন করীমে উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করা হয়েেছ,
يَا أَيُّهَا ٱلَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
হে যারা ঈমান এনেছ তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েেছ যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়িেছল। যাতে করে তোমরা তাক্ওয়া অবলম্বন করতে পার”। (সূরা বাকারা: ১৮৩
অপর এক আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন,
রমযান মাস হচ্ছে সেই মাস যার মাঝে কুরআন করীম নাযেল করা হয়েেছ। যা মানুষের জন্য পরিপূর্ণ হেদাযাত, পথ প্রদর্শনের দলিল এবং সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য নির্ণযকারী। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে এই মাসকে পাবে তাকে অবশ্যই রোযা রাখতে হবে। আর যদি কেউ রুগ্ন হয় অথবা সফরে থাকে তাহলে সে সমপরিমাণ রোযা অন্যান্য দিনসমূহে আদায করবে। আল্লাহ্ পাক তোমাদের জন্য স্বাচ্ছন্ধ চান এবং তোমাদের জন্য কাঠিন্য চান না এবং যেন তোমরা গণনা পূর্ণ কর এবং আল্লাহর মহিমা কীর্তন কর এইজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে হেদাযাত দিযেেছন এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর”। (সূরা বাকারা: ১৮৬
বিভিন্ন নবীদের রোজা :
ক.হযরত আদম (আ.)-এর রোজা :
হযরত আদম (আ.) যখন নিষিদ্ধ ফল খেয়িেছলেন এবং তারপর তাওবাহ করেছিলেন তখন ৩০ দিন পর্যন্ত তাঁর তাওবাহ কবুল হযনি। ৩০ দিন পর তাঁর তাওবাহ কবুল হয। তারপর তাঁর সন্তানদের উপরে ৩০টি রোযা ফরয করে দেযা হয।
খ.হযরত নূহ (আ.)-এর রোজা :
নূহ (আ.)-এর যুগেও সিয়াম ছিল। কারণ, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন: হযরত নূহ (আ.) ১লা শাওয়াল ও ১০ জিলহজ ছাড়া সারা বছর রোযা রাখতেন
গ.হযরত ইবরাহীম (আ.) ও বিভিন্ন জাতির রোজা :
হযরত নূহ (আ.)-এর পরে নামকরা নবী ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.)। তাঁর যুগে ৩০টি সিয়াম ছিল বলে কেউ কেউ লিখেছেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর কিছু পরের যুগ বৈদিক যুগ।ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বেদের অনুসারী ভারতের হিন্দুদের মধ্যেও ব্রত অর্থাৎ উপবাস ছিল। প্রত্যেক হিন্দী মাসের ১১ তারিখে ব্রাহ্মণদের উপর একাদশীর’ উপবাস রযেেছ।
ঘ.হযরত দাউদ (আ.)-এর রোজা:
হযরত মূসা (আ.)-এর পর কিতাবধারী বিখ্যাত নবী ছিলেন হযরত দাউদ (আ.)। তাঁর যুগেও রোযার প্রচলন ছিল। আল্লাহর রাসুল বলেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নিকট সবচেয়ে প্রিয় রোযা হযরত দাউদ (আ.)-এর রোযা। তিনি একদিন রোযা রাখতেন এবং একদিন বিনা রোযায থাকতেন (নাসাঈ ১ম খণ্ড ২৫০ পৃষ্ঠা, বুখারী, মুসলিম,মিশকাত ১৭৯ পৃষ্ঠা)। অর্থাৎ হযরত দাউদ (আ.) অর্ধেক বছর রোযা রাখতেন এবং অর্ধেক বছর বিনা রোযা থাকতেন।
ইহুদীদের মাঝেও রোযা ছিল আল্লাহ্র আরোপিত ফরজ ইবাদত। হযরত মূসা (আ.) কুহে তুরে চল্লিশ দিন পর্যন্ত ক্ষুৎ-পিপাসার ভিতর দিয়ে অতিবাহিত করেছেন। (নির্গ: ৩৪-৩৮) সুতরাং সাধারণভাবে হযরত মূসা (আ.)-এর অনুসারীদের মাঝে চল্লশি রোযা রাখাকে উত্তম বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু তাদের ওপর চল্লশিতম দিনে রোযা রাখা ফরজ বা তাদের সপ্তম মাসের (তাশরিন) দশম তারিখ পড়ত। (তৌরাত: সফরুল আহবার: ১৬-২৯-৩৪: ২৩-২৭) এজন্য এই দশম দিনকে আশুরা বলা হতো। আর আশুরার এই দিনটি ছিল ঐ দিন যেদিন হযরত মূসা (আ.)কে তৌরাতের ১০ আহকাম দান করা হয়িেছল। এইজন্য তৌরাত কিতাবে এই দিনের রোযাকে পালন করার প্রতি জোর তাগিদ করা হয়েেছ। বস্তুতঃ উপরোল্লিিখত দিক-নির্দেশনা ছাড়া ইহুদীদের অন্যান্য ছহীফাসমূহের মাঝে অন্যান্য দিনের রোযার হুকুম-আহকামও বিস্তৃতভাবে পাওয়া যায়। (প্রথম শামুয়লে ৭-৬ এবং ইয়ারমিয়া ৩৬-৬) খৃষ্টান ধর্মে বর্তমান কালেও রোযার প্রভাব বিদ্যমান। হযরত ঈসা (আ.)ও চল্লশি দিন পর্যন্ত জঙ্গলে অবস্থান করে রোযা রেখেছেন।
হযরত ইয়াহইয়া (আ.) যিনি হযরত ঈসা (আ.)-এর সমসাময়িক ছিলেন তিনিও রোযা রাখতেন এবং তার উম্মতগণের মাঝেও রোযা রাখার রীতির প্রচলন ছিল।
ইহুদীরা বিভিন্নকালে অসংখ্য ঘটনাবলীর স্মৃতিস্বরূপও এর সাথে অনেকগুলো রোযা সংযোজন করেছিল। এর অধিকাংশই ছিল বেদনাময় স্মৃতির স্মরণিকা । এই সকল রোযার মাধ্যমে তারা নিজেদের অতীত বেদনাময় স্মৃতিগুলোকে উজ্জীবিত করে তুলতো । এমন কি দেহ-মনের মাঝেও বেদনা ছাপ ফুটিয়ে তুলতো । হযরত ঈসা (আ.) স্বীয় আমলে কিছু সংখ্যক রোযা রাখার অনুমতি বা অবকাশও ছিল। একবার কতিপয় ইহুদী সমবেত হয়ে হযরত ঈসা (আ.)-এর নিকট এই আপত্তি উত্থাপন করলো যে, তোমার অনুসারীরা কেন রোযা রাখছে না।
হযরত ঈসা (আ.)-এর জবাবে বলেন, তবে কি বরযাত্রীগণ যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের সাথে অবস্থান করে তারা ততক্ষণ পর্যন্ত রোযা রাখতে পারে না। সুতরাং এমন এক সময় আসবে যখন দুলা তাদের সাথে থাকবে না তখন তারা রোযা রাখবে।”
এই দিক নির্দেশনায় দুলা বলতে নির্দেশ করা হয়েেছ হযরত ঈসা (আ.)-এর পবিত্র সত্তাকে এবং বরযাত্রী বলা হয়েেছ তার অনুসারী হাওয়ারীদেরকে। একথা সুস্পষ্ট যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোন স্বীয় উম্মতের মাঝে অবস্থান করেন ততক্ষণ উম্মতদের শোক পালনের কোন প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় না । সুতরাং উপরোল্লিিখত বর্ণনার দ্বারা বুঝা যায় যে, হযরত ঈসা (আ.) হযরত মূসা (আ.) এর আমলে প্রবর্তিত ফরজ এবং মোস্তাহাব রোযাসমূহকে নয়; বরং শোক পালনার্থে প্রচলিত নব্য রোযার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন এবং তিনি স্বীয় অনুসারীদেরকে পূর্ণ আন্তরিকতা ও বিশুদ্ধচিত্ততার সাথে রোযা রাখার উপদেশ প্রদান করতেন। যেমন,
”অতঃপর তোমরা যখন রোযা রাখবে তখন লোক দেখানো মনোবৃত্তি সম্পন্ন মানুষের মত নিজেদের মুখমন্ডলকে উদাস করে রাখবে না । কেননা, এই শ্রেণীর লোক নিজেদের মুখমন্ডলের আসল রূপ বিকৃত করে ফেলে যেন মানুষ মনে করে যে তারা রোযাদার । আমি তোমাদের কাছে সত্য কথাই বলছি। এ শ্রেণীর লোকেরা তাদের বিনিময় পেয়ে গেছে । সুতরাং তোমরা যখন রোযা রাখবে তখন মাথায় তেল ব্যবহার করবে, মুখমন্ডল ধৌত করবে । এতে করে তোমরা মানুষের নিকট নয় বরং তোমাদের পিতার নিকট গোপনীয় ভাবে অবস্থান করবে। তোমরা যারা রোযাদার তা সুস্পষ্ট এবং তোমাদের পিতার নিকট যা প্রচ্ছন্ন ও গোপনীয় তিনি তার সরাসরি প্রতিফল ও বিনিময় অবশ্যই প্রদান করবেন’।
রমাদানের শিক্ষা সমুহ :
রমাদানের শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করতে হলে শুরুতে বুঝতে হবে কেন রমাদানের এতো গুরুত্ত?কেননা এই রমজান মাসেই নাজিল হয়েছে হেদায়াতের চুড়ান্ত কিতাব আল কোরআন।যেই কোরআনের জন্য রাসুল সঃ, তার সাহাবিগন,তার উম্মতগন সহ পুরা মুসলিম জাতি সন্মানিত। যেই কোরআনের আলোয় আলোকিত হয়েছিল গোটা জাহান।দিকে দিকে নেমে এলো প্রশান্তি। কেটে গেলো অন্ধকার। দূর হলো মানুষের গোলামী,চালু হলো আল্লাহর গোলামী। দূর হলো ভেদাভেদ,চালু হলো ভ্রাতৃত্ব। জুলুম দূর হলো,অধিকার ফিরে এলো। গোটা মানব জাতি পলে তাদরে পথ চলার আলো। তাদরে উন্নতির শিখরে পৌঁছানোর সব তথ্য ও মাধ্যম। রমজান বছর ঘুরে ফিরে এসে আমাদরে স্বরন করয়িে যায় যে,আমরা কি সেই কোরআনরে আলোয় পথ চলছি? আমরা কি কোরআনরে সেই তথ্য দিয়ে উন্নতির পথে গবষেণা করছি?
১ .
কোরআন বলছে,মুমিনদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে তাকওয়া অর্জন করার জন্য।
তাকওয়া শব্দের একটি অর্থ আল্লাহ ভীতি । রমজান কি তাকওয়া শিক্ষা দিচ্ছে ? আপনি ইফতারি নিয়ে বসে আছেন কিন্তু ইফতারির এখনো ৫ মিনিট বাকি আছে, কিন্তু আপনি খাচ্ছেননা । ইচ্ছা করলেই খেতে পারেন, কিন্তু কেন খাচ্ছেননা ? আল্লাহর ভয়ে । কারন সময় হওয়ার আগে খেতে নিষেধ করেছেন আপনার মালিক । মালিকের কথা না শুনলে মালিক শাস্তি দেবে । এই ভয়টাই হলো তাকওয়া।
মুত্তাকি বান্দা আল্লাহকে শুধু ভয়ই করেনা ভালোবাসে ও। তাই জীবন চলে গেলেও সে আল্লাহর আইন ভঙ্গ করবে না। ঠিক এই শিক্ষাটাই রমাদান দিতে চায় যে, রমজানে যেমনি করে ৫ মিনিট আগে ইফতারি করেন না আল্লাহর ভয়ে, অনুরূপ জিবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আল্লাহর এই ভয়টা নিয়ে চলতে হবে । তার নির্দেশ অমান্য করা যাবে না । ঠিক আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তাই পালন করতে হবে, যা নিষেধ করেছেন তা বর্জন করতে হবে। এমনকি আল্লাহর নির্দেশ মানতে গিয়ে যদি আপনার উপর নির্যাতন ও আসে তবুও আল্লাহর পথ থেকে সরে যাওয়া যাবে না । মুত্তাকি বান্দা কোনো অবস্থাতেই মালিকের পথ থেকে এক চুলও নড়েনা । আর এই ভাবেই মুত্তাকীরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে।
২ .
গরিব মিসকিনের ক্ষুধার জ্বালা অনুভব করা।
মুত্তাকি তারা যারা এই রমজানে ইফতারি আর সেহেরীতে পেট পুরে শুধু খায় না। বরং গরিব মিসকিন অসহায় মানুষের না খেয়ে থাকার কষ্ট অনুভব করে। এবং নিজের ইফতারি ও সেহরিতে গরিব মিসকিনকে শামিল করে । এতে তার মধ্যে মানবতা বোধ তৈরি হয় । আর রমজান মুত্তাকীদের এই শিক্ষাটাই দিয়ে যাচ্ছে। যারা শিক্ষাটা কাজে লাগাচ্ছনে তারা মুত্তাকী বান্দায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে এবং নিজেকে জান্নাতি হিসেবে গড়ে তুলছেন।
৩.
মাহে রমজান ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহানুভূতির শিক্ষা দিয়ে থাকে।
এ মাসের কারণে মানুষ ক্ষুধা ও তৃষ্ণার জ্বালা বুঝতে পারে। এ জন্য এক মুমিনের হৃদয় ধাবিত হয় অন্য মুমিনের সুখ-দুঃখের খবর সন্ধানে। যার বাস্তব রূপ প্রকাশ পায় ইফতারের মাধ্যমে । রাসূলে পাক (সা.) এরশাদ করেন, রমজান মাসে যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহগুলো মাফ হয়ে যাবে। সে দোজখ থেকে মুক্তি পাবে আরসে রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে, কিন্তু এতে রোজাদারের সওয়াব থেকে কিছুই ঘাটতি হবে না অর্থাৎ রোজাদারের সওয়াব কমবে না।
এরূপ সওয়াব আল্লাহ তায়ালা এমন ব্যক্তিকে দেবেন, যে শুধু এক পেয়ালা দুধ অথবা একটি খেজুর বা সামান্য পরিমাণ পানি দ্বারাও কাউকে ইফতার করাবে । আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তি মিটিয়ে খাওয়াবে আল্লাহ তাকে হাউজে কাওসার থেকে এমন শরবত পান করাবেন যাতে সে কখনও তৃষিত হবে না। এভাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (বায়হাকি)
সাহাবীরা বলেন, হে আল্লাহর রসূল (স.) আমাদের এমন কিছু নেই যা দিয়ে আমরা কাওকে ইফতার করাতে পারি ? তিনি (স.) বলেন, আল্লাহ তাকেও এই সওয়াব দেবেন, যে ব্যক্তি কোন রোজা পালনকারীকে এক ঢোক দুধ অথবা একটা শুকনো খেজুর কিংবা এক চুমুক পানি দিয়েও ইফতার করাবে আর যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে পরিতৃপ্তি সহকারে খাওয়াবে আল্লাহ তাকে আমার “হাউজে কাওছার” থেকে এমন ভাবে পানি পান করাবেন যার ফলে, সে জান্নাতে না পৌছানো পর্যন্ত আর তৃষ্ণার্ত হবে না। ( বায়হাকী ওয়াবুল ঈমান, মেশকাত ১৭৪ পৃষ্ঠা) ।
ভেদাভেদ ভুলে সকলে যখন একসাথে বসে ইফতারি করে, মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব,সহানুভুতি ও ভালোবাসা তৈরি হবেই । সুতরাং সমাজে আজো যদি সৌহার্দ ফিরিয়ে আনতে চান তবে রাসুলের অনুসৃত পথে রমাদানের দেয়া শিক্ষা গুলো নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করুন ।
৪.
হারাম উপার্জন ও হারাম খাওয়া থেকে দূরে থাকা।
হাদিস থেকে জানা যায় ফরজ বাদ দিলে এবং হারাম কাজে জড়িত হলে রোজা রাখা শুধু ক্ষুধা, পিপাসা ও রাত্রি জাগার কস্ট ছাড়া আর কিছুই নয় । অর্থাৎ রোজা দ্বারা তখন কোনো সাওয়াব আশা করা যায় না । কোনো কাজ করে যদি সেই কাজের কোনো লাভ পাওয়া না যায় তাহলে সে কাজ করা তো বোকামি । সুতরাং মুমিন, মুত্তাকীদের কাজ হোলো মুত্তাকী বোকামির কোনো কাজ করে না । তাই মুত্তাকী সে, যে শুধু রমজান মাসের কল্যান লাভের আশায় এই মাসে হারাম উপার্জন ও হারাম খাওয়া থেকে দূরে থাকবে না বরং সারা বছর দূরে থাকবে । কেননা মুত্তাকীর বিশ্বাস থাকবে বরকত দেয়ার মালিক তো আল্লাহ তায়ালা । হারাম বাইরে থেকে যতই বেশী আর চাকচিক্যময় দেখাক না কেন পরিশেষে হারামে বরকত থাকে না । আর হালাল উপার্জন বাইরে থেকে যতই কম মনে হোক না কেন পরিশেষে হালালেই বরকত । কারন হালাল পথের উপার্জন এর সংরক্ষক স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নিজেই । আর হারামের সংরক্ষক ব্যক্তি নিজে । সুতরাং ব্যক্তি নিজেই নিজের জীবনের সংরক্ষণ করতে পারেনা! সম্পদের সংরক্ষণ করবে কিভাবে? রাসুল সঃ বলছেনে, ফরজ আদায়রে পর বড় ফরজ হল হালাল উর্পাজন” ।
৫.
আল্লাহর স্বরণ ও তার প্রতি আনুগত্য।
মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হল আহারের প্রতি ঝোঁক থাকা । তার জৈবিক চাহিদা মিটানো । চিন্তা করুন স্বাধীন চেতা সেই মানুষটা সারাদিনের আহার বাদ দিয়ে জৈবিক চাহিদা বাদ দিয়ে রোজা রাখে ।কেন রাখে ? অবশ্যই আল্লাহর আদেশের আনুগত্য করার জন্য। আর এই আনুগত্য করতে গিয়ে রোজাদার চমৎকার এক অভ্যাস করে ফেলতে পারে । সারা দিন আপনি রোজা থাকাকালীন যখনি আহার করার চিন্তা করেন তখনি স্বরনে আসে আমিতো রোজাদার । আমার আল্লাহ তো আমাকে নিষেধ করেছেন রোজা থাকাকালীন খাদ্য না খেতে । রোজা থাকাকালীন যখনি জৈবিক চাহিদা মিটানোর ইচ্ছা হয় তখনি স্বরনে আসে আমিতো রোজাদার । আমার আল্লাহ তো আমাকে এই অবস্থায় জৈবিক চাহিদা মিটানো নিষেধ করেছেন । কেউ ঝগড়া করতে আসলো বা আপনাকে গালি দিলো, আপনিও তাকে গালি দিবেন বলে ঠিক করলেন তখনি আপনার স্বরনে আসলো আমিতো রোজাদার । মুত্তাকী হওয়ার এমন সুযোগ রমজান আমাদের দিয়ে যাচ্ছে । আল্লাহ সচেতন মানুষগুলো এর থেকে শিক্ষা নেবে । আর জাহান্নামীরা রমজান পেয়েও জাহান্নামী হবে । তাইতো রাসুল সঃ বলেছেন আল্লাহ তিন ব্যক্তির উপর লানত দেন । তার মধ্যে এক শ্রেনী হল যারা রমজান পেল অথচ গোনাহ মাফ করাতে পারলনা ।
৬.
আল কোরআনের শিক্ষা গ্রহন করা।
রমজান আমাদের স্বরন করিয়ে দেয় এই মাসেই নাজিল হয়েছে মানব জাতির মুক্তির সমাধান কোরআন । যেই কোরআন দিয়েই রাসুল সঃ এক দুর্ধষ জাতিকে সোনার মানুষে পরিণত করেছিলেন । সাহাবীগন হয়ে ছিলেন এক একজন মানবতার অগ্রদূত । তাহলে কেনো আজ মুসলিমরা চরম অধঃপতিত? অথচ সেই কোরআন আজও অবিকৃত অবস্থায় বিদ্যমান । কারণটা হল কোরআন আগের মতই আছে কিন্তু কোরআনের শিক্ষাটা নেয়া হচ্ছে না, কোরআন বুঝে পড়ছে না মুসলিমরা । রমজানে প্রতিযোগিতা হয় কে কত খতম দিতে পাওে । অথচ একবারও ভাবেনা এই কোরআন কি খতম দেয়ার জন্য এসেছে ? দুনিয়ার এমন কোনো বই কি আছে যে বই বুঝে পড়ি না ? সব বই বুঝে পড়ি শুধু কোরআন বুঝে পড়িনা! অবিশ্বাসীরা সুকৌশলে মুসলিম জাতিকে কোরআনের শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে । সুতরাং হারানো সালতানাত আবার ফিরে পেতে হলে কোরআনের দিকে ফিরে আসতে হবে । কোরআনের শিক্ষাগুলো ময়দানে প্রয়োগ করতে হবে । রমজানে শুধু অন্ধের মত খতম নয়, কোরআন বুঝে পড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে । কোরআন বলছে, “যাদেরকে তাওরাত বহন করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল অতঃপর যারা তা যথাযথভাবে বহন করেনি তাদের দৃষ্টান্ত হল পুস্তকের বোঝা বহনকারী গাধার মত”।সুরা জুময়াঃ৫।
কোরআন দিয়েই কেবল পৃথিবীতে শান্তি এসেছিল তার প্রমান রাসুলের যুগ,খোলাফায়ে রাশেদার যুগ এবং মুসলমানেরা যতদিন কোরআনের সঠিক অনুসারী ছিল সেই যুগ । পৃথিবী সাক্ষী দেয় অন্য কোনো জাতি তা পারেনি । আমি বুঝিনা মানুষ কি করে ভাবে যে, মানুষের তৈরি করা মতবাদে শান্তি আসবে । অথচ মানুষ নিজেই নিজের জীবনের শান্তি নিশ্চিত করতে সামর্থ নয় । আল্লাহ আমাদেরকে কোরআনের পথে পরিচালিত করে তার প্রিয় বান্দা হওয়ার তাওফিক দান করুন ।
সোলায়মান রাকিব (ইসলামি চিন্তাবীদ ও গবেষক)