নিজস্ব প্রতিবেদক:
অসংখ্য দিবস আমরা পালন করে থাকি। সরকারি বা বেসরকারি, জাতীয় বা আর্ন্তজাতিক, ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক। এসবের বাইরেও কিছু দিবস আমাদের জানার বাইরে থাকে, যার তাৎপর্য কোনো অংশেই কম নয়। এরকম একটি দিবস হল চা-শ্রমিক দিবস বা ‘মুল্লুক-চল’ দিবস।
১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়ায় যখন প্রথম চায়ের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় তারপর থেকেই আসাম অঞ্চলে (সিলেট তখন আসামের অংশ) চা-শিল্পের ব্যাপক বিস্তার লাভ করতে থাকে। চা-শিল্প মূলত একটি শ্রমঘন শিল্প। চা শিল্পের বিস্তারের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাড়ায় শ্রমিক সংকট। ১৮৫৩ সালে আসামে প্রতি বর্গমাইলে লোকসংখ্যা ছিল ৩০ জন, সিলেটে ছিল ২০০ জন। তাছাড়া আসামের মাটি ছিল সোনা ফলা। ফলে এই অঞ্চলের কৃষকরা চা বাগানে কাজ করাকে অসম্মানজনক মনে করত।
এর জন্যে ব্রিটিশরা চা শ্রমিকের জন্য আসামের বাইরে হাত বাড়ায়। মূলত বিহারের ছোট নাগপুর, উড়িষ্যা, অন্ধপ্রদেশ, মধ্য প্রদেশ থেকে এই সব শ্রমিকদের সংগ্রহ করা হয়। শ্রমিক সংগ্রহকারীরা এই সমস্ত দারিদ্রপীড়িত এলাকার মানুষকে এক সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে জাহাজে তোলে। তারপরই শুরু হয় এক করুণ কাহিনি। যে জাহাজে ২০০ জনের ধারণক্ষমতা সেখানে তোলা হয় ১০০০ জনকে। পথ কাটে ক্ষুধা আর যন্ত্রণায়। জাহাজ যখন ঘাটে ভিড়ে তখন লাশ এবং জীবন্ত মানুষের সংখ্যা থাকে সমান। এরপর তাদেরকে নিয়ে আসা হয় আসামে তাদের জন্য নির্ধারিত এলাকায়।
এখন যেখানে সবুজ সুন্দর চা বাগান দেখা যায় সেখানে তখন ছিল বিস্তীর্ন জঙ্গল। এই জঙ্গলে ছিল হিংস্র পশুপাখি আর পোকা-মাকড়। শ্রমিকদের প্রাথমিক কাজ ছিল এই ভয়ঙ্কর জঙ্গল পরিষ্কার করে চা বাগানের উপযোগী করা। অপরদিকে চা বাগানের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল ইংরেজরা। আসামের এই জঙ্গলে তখন দাগী অপরাধী, বখাটে এবং উচ্ছৃঙ্খল ইংরেজদের পাঠানো হত। একদিকে ভয়ঙ্কর জঙ্গল, হিংস্র জন্তু-জানোয়ার, অর্ধহার, অনাহার, রোগ শোক অন্যদিকে ইংরেজদের অমানবিক আচরণ। দ্রুতই এইসব অসহায় মানুষদের রঙিন স্বপ্ন ফিকে হয়ে যেতে থাকে। মরতে থাকে তারা গণহারে।
সরকারি এক হিসেবে দেখা যায়, প্রথম তিন বছরে যে ৮৪ হাজার ৯১৫ জন শ্রমিক আমদানি করা হয়েছিল তার মধ্যে ৩১ হাজার ৮৭৬ জন এভাবেই মারা যায়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যখন সারাদেশে স্বদেশী আন্দোলন চলছিল তখন এর ঢেউ চা বাগানগুলোতেও পরে। চা-শ্রমিকরাও আস্তে আস্তে তাদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হতে থাকে, অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে থাকে।
তাদের নেতা পন্ডিত দেওশরন এবং গঙ্গা দীতির নেতৃত্বে ১৯২১ সালের ২০ মে ‘মুল্লুক চল’ বা ‘দেশে চল’ কর্মসূচির ডাক দেয়। সিলেটের বিভিন্ন চা বাগান থেকে পঙ্গপালের মত বের হয়ে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক সিলেট রেলস্টেশনে এসে জড়ো হয়। কিন্তু বৃটিশ সরকার রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তারা তখন রেলপথ ধরে হেটে চাঁদপুর স্টিমার ঘাটে পৌঁছায়।
চাঁদপুরে স্টিমারঘাটে বৃটিশ সরকার গুর্খা রেজিমেন্টের সৈন্যদের দ্বারা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শতশত শ্রমিককে হত্যা করে। কত মানুষ ওইদিন নিহত হয়েছিল তার পরিসংখ্যান কখনও জানা যায়নি। তারপর থেকেই ঐদিনকে চা শ্রমিকরা ‘চা-শ্রমিক দিবস’ বা ‘মুল্লুক চল দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।
আজ চা-শিল্পে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দিক থেকে দ্বিতীয়, মোট জিডিপির ১% আসে এই শিল্প থেকে, ১৬২টি চা বাগানে প্রায় তিন লক্ষ চা-শ্রমিক কর্মরত। সবুজ মনোরম চা-বাগানগুলো লক্ষ লক্ষ পর্যটক আকর্ষণ করে। এই সমস্ত কিছুর পেছনে জড়িয়ে আছে রক্ত, ঘাম, ইজ্জত লুন্ঠন আর অত্যাচারের কাহিনি। আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে যখন আমরা সতেজ হই এই করুণ কাহিনি তখন আমাদের অজানা থেকে যায়। আজ এই দিনে শ্রদ্ধা জানাই এই নিপীড়িত মানুষ জনের প্রতি।