নিজস্ব প্রতিবেদক:
গোটা হাওরাঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহতম বিপর্যয়ে সেখানে পানীয়, বাসস্থান ও চিকিৎসাসহ নানাবিদ সঙ্কটে ঋণগ্রস্ত ফসলহারা কৃষক, কিষাণী, জেলে ও খামারিদের মধ্যে এখন হাহাকার চলছে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, মদন, কলমাকান্দা, বারহাট্টা, পূর্বধলা, সদর উপজেলা ও খালিয়াজুরী উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এই বিপর্যয়ের ঘূর্ণিপাকে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক-কিষাণীদের আর্তনাদ ও কান্না কিছুতেই থামতে চাইছে না।
দেশের বিশাল খাদ্যভাণ্ডার গোটা হাওরাঞ্চলে বোরো মওসুম শুরুর প্রাক্কালে প্রবল বর্ষণ ও ভারতের মেঘালয় এবং আসাম রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের তোড়ে নড়বড়ে বেড়িবাঁধগুলো একের পর এক ভেঙে উঠতি ফসল তলিয়ে যায়। ফসল ওঠার পর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের অন্যতম অবলম্বন মৎস্য ভাণ্ডারের আধার হাওরে অজ্ঞাত এক রহস্যজনক গ্যাসের প্রভাবে টনের পর টন মাছ মরে পানিতে ভাসতে থাকে। আর সেই বিষাক্ত মাছ খেয়ে হাজার হাজার হাঁস মরতে থাকে। একের পর এক বিপর্যয়ে হাওরাঞ্চলের মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েন। বোরো মওসুমে ফসল ওঠার সময় যে কৃষক-কিষাণীরা দুই হাতে অকাতরে লোকজনের মধ্যে ধান বিলিয়ে দিতেন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তারাই এখন ত্রাণের আশায় প্রহর গুনছেন। হাওরাঞ্চলের লোকজনদের এখন একবেলা, আধাবেলা ও অনেক পরিবারের সদস্যদের না খেয়ে অভুক্ত থাকতে হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে, তা প্রয়োজনের চেয়ে নগণ্য। ছিটেফোঁটা এই ত্রাণ কিছুতেই তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। পাশাপাশি বহু পরিবার এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণই পাননি। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দ্বীপ উপজেলা খালিয়াজুরতে প্রতি পরিবারে ৩৮ কেজি করে চাল দেয়ার কথা থাকলেও অন্তত সাত-আট কেজি করে কম দেয়া হচ্ছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেখানকার ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন। সেখানকার বেশির ভাগ লোকজনের হতাশার অন্যতম কারণ হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত পাশের সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পদার্পণ করলেও তুলনামূলকভাবে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত খালিয়াজুরীতে তাদের কেউ না আসা। এমন কি ওই অঞ্চলের বেশির ভাগ ভোট পেয়ে যে রেবেকা মমিন এমপি নির্বাচিত হন, তিনিও এখন পর্যন্ত সেখানে না যাওয়ায় অনেকের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
ক্ষেতের সোনালি ধান, অফুরন্ত মাছ ও হাঁস পালন করে যে হাওরবাসীদের জীবনমান ভালোই চলত অথচ আজ তারা অভাবী। ভরা বর্ষা মওসুমে হাওরাঞ্চলে নানা পার্বণ আর অসংখ্য বিয়ের উৎসবে চার দিকে আনন্দে মুখরিত হয়ে উঠত আর এখন সেখানে বুকফাটা আর্তনাথ আর কৃষক-কিষাণীদের কান্নায় এক বিষাদময় পরিবেশ বিরাজ করছে। অতীতে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কৃষকরা বহুবার ফসল হারিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হলেও এবারের মতো এমন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হাওরবাসী আর কখনো হননি। ফসলহারা ঋণগ্রস্ত কৃষকেরা কিভাবে পরিবারের জন্য খাদ্য সংগ্রহ ও মহাজনদের ঋণ পরিশোধ করবেন সেই দুশ্চিন্তায় বিচলিত হয়ে পড়েছেন। সরকারের নির্দেশনা থাকার পরেও নেত্রকোনায় স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতি, আশা, ব্র্যাক, পপিসহ বহু এনজিও এখন পর্যন্ত হাওরাঞ্চলের কৃষকদের ঋণের কিস্তি স্থগিত বা মওকুফের কোনো ঘোষণা দেয়নি। তাই নিরুপায় হয়ে অনেকে স্ত্রীর অলঙ্কার, আসবাবপত্র এমনকি গোয়ালের গরু পর্যন্ত বিক্রি করে দিচ্ছেন। মোহনগঞ্জ, মদন ও খালিয়াজুরীর ফসলহারা সচ্ছল কৃষক পরিবারগুলো এখন অভাবের তাড়নায় বিপাকে পড়েছে। তারা আত্মসম্মান বোধ বিকিয়ে সাহায্যও গ্রহণ করতে পারছেন না আবার সংসারেরও ব্যয়ভার বহন করতে পারছেন না।
চলতি মওসুমে নেত্রকোনা জেলায় এক লাখ ৮০ হাজার ১০২ হেক্টর বোরো জমিতে চাষাবাদ করা হয়। শুরুতে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বোরো ফসলের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে এক লাখ ৮৪ হাজার ৩২০ হেক্টর অর্জিত হলেও অকালে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে অন্তত ৯০ ভাগ ফসল তলিয়ে কৃষকদের সব স্বপ্নসাধ বানের পানিতে বিলীন হয়ে গেছে।
খালিয়াজুরী উপজেলার সাতগাঁও গ্রামের নিঃস্ব হয়ে পড়া সখিনা বেগম বলেন, ‘বানের পানি আমরার সব শ্যাষ কইরা দিছে। সদর উপজেলার স্বল্পদুগিয়া গ্রামের খুরশেদ মিয়া (৭৫) বলেন, রুমা বিলে পানিতে তলিয়ে আমার চাষকৃত ৩৫ একর ধান বিনষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের এলাকায় কোনো ত্রাণ দেয়া হয়নি। রুহি গ্রামের মাওলানা আবদুল খালেক বলেন, এর আগেও অনেকবার পানিতে ফসল নষ্ট হতে দেখেছি; কিন্তু এবারের মতো ভয়াবহ অবস্থা আর কখনো দেখিনি। বানের পানিতে ঘাগডিয়া বিলে আমার দুই একর ৪০ শতক জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এক মুঠো ধানও ঘরে তুলতে পারিনি।
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আবু তাহের বাঁধের দুরবস্থার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে মোহনগঞ্জের ডিঙ্গাপোতা ও খালিয়াজুরীর কিত্তনখলাসহ বেশ কয়েকটি বাঁধ ভেঙে কমপক্ষে ৩৫ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আবু তাহেরের আগে নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিগ্রস্ত নির্বাহী প্রকৌশলী শশী মোহন সরকারের আমলে বাঁধ নির্মাণের নামে কোটি কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। বরাবরই বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের সময় তদরকির অভাবে হরিলুট করার কারণে সামান্য পানির তোড়ে প্রতিবারই বাঁধ ভেঙে কৃষকদের কপাল ভাঙলেও দুর্নীতিবাজরা পার পেয়ে যান। আর যখন বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে হাহাকার শুরু হয়, তখনই টনক নড়ে সংশ্লিষ্টদের।
নেত্রকোনার বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন পাউবোর দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে এখন সোচ্চার হয়ে উঠেছে। পাউবোর দুর্নীতিপরায়ণ বিদায়ী নির্বাহী প্রকৌশলী শশী মোহন সরকারসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও জড়িত ঠিকাদারদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে বিভিন্ন সংগঠন ইতোমধ্যে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত শশী মোহনসহ কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
জন উদ্যোগের সভাপতি কামরুজ্জামান চৌধুরী, নেত্রকোনা উন্নয়নে নাগরিক আন্দোলনের সভাপতি খানে আলম খান ও নেত্রকোনা খেলাফত যুব আন্দোলনের সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের কারণে হাওরের বাঁধ ভেঙে অকালে ফসল তলিয়ে কৃষকেরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। হাওর ও কৃষকদের বাঁচাতে হলে প্রথমেই এর জন্য দায়ী দুর্নীতিগ্রস্তদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।