নিজস্ব প্রতিবেদক:
কালবৈশাখী ঝড় আর বজ্রপাত এবার যেন মরার ওপর খারার ঘাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছে হাওরবাসীর জন্য। প্রতিদিনেই সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে বজ্রাঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে অসহায় কৃষক। গত এক মাসের ব্যবধানে বজ্রপাতে ১৫ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও আহত হয়েছেন ১৬ জনের বেশি। জেলার তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, বিশ্বম্ভরপুর, দিরাই, শাল্লা, ছাতক, দোয়ারা-বাজার উপজেলায় বজ্রপাতের আগাতে মারা যায় এসব কৃষক। একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তিটিকে হারিয়ে নির্বাক অনেক পরিবার।
হাওরপারের আকাশ-বাতাস এখন প্রিয়জন হারানোর কষ্টে ভারী হচ্ছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে সারাক্ষণই প্রিয়জন হারানোর আতঙ্ক বিরাজ করছে জেলার সর্বস্তরের মানুষের মাঝে।
গত দুই বছর অকাল বন্যায় ৯০ শতাংশ বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ার শোক কিছুটা এবার লাঘব হয়েছিল ভালো ফসল হওয়ায়। কিন্তু হাওরপারে এখন সেই আনন্দে বাঁধ সেধেছে কালবৈশাখী ঝড় আর বজ্রপাত। অকাল বন্যায় বোরো ধান পানিতে না ডুবালেও হাওরাঞ্চল এবার যেন এবার মৃত্যুর মিছিলে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে বজ্রপাত, ঝড়-বৃষ্টির কারণে রোদ না থাকায় ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর কাজ করতে পারছে না কৃষকরা। হাওরে প্রকৃতির এই বিরূপ নির্মমতায় হতবাক আর পাকা ধান নিয়ে দিশেহারা কৃষক।
শুধু সুনামগঞ্জ জেলাই নয় হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলে একেই অবস্থা বিরাজ করছে বলে জানা যায়। বজ্রপাত প্রতিরোধক যন্ত্র স্থাপন ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ দ্রুত নেওয়ার দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে হাওরবাসীসহ সর্বমহলে।
বজ্রপাতে গত এক মাসের ব্যবধানে সুনামগঞ্জে ১৫ জন নিহত হয়েছেন। ১ মে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মোল্লারপাড়া ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামের রশিদ মিয়া (৪৫), একেই দিনে জামালগঞ্জ উপজেলা কমলা কান্ত তালুকদার (৫৫)। তিনি জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাঁক ইউনিয়নের খোজারগাঁও গ্রামের মৃত কৃষ্ণধন তালুকদারের ছেলে। একই উপজেলার ভীমখালী ইউনিয়নের কলকতা গ্রামের মুক্তার আলীর ছেলে হিরণ মিয়া (৩০), বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের মৃত সাইদুর রহমানের ছেলে আলম মিয়া (৫০) মারা যান।
৪ মে শুক্রবার সকালে মোহাম্মদ জাফর মিয়া (৩৬) নামে একজন বজ্রঘাতে মারা যায়। তিনি উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের গড়কাটি গ্রামের মৃত লাল মামুদ আলীর ছেলে।
৫ মে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের গৌরারং (ইসলামগঞ্জ) ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী একা রানী দাশ (১৮)। তিনি গৌরারং ইউনিয়নের সাফেলা গ্রামের রাদিকা দাশের মেয়ে। ও একই গ্রামের মৃত আব্দুল খালিকের ছেলে এখলাছুর রহমান (৫০)।
৭ মে শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওরে সকালে বজ্রপাতে নবকুমার দাস (৬৫) নামে এক কৃষক নিহত হয়েছেন। তিনি উপজেলার নিয়ামতপুর গ্রামের পুলিশ কর্মকর্তা এসআই নগেদ্র দাসের পিতা।
৮ মে তাহিরপুর উপজেলায় সদর ইউনিয়নের ভাটি তাহিরপুর গ্রামের মুক্তুল হোসেনের ছেলে কৃষক নূর হোসেন (২২), একই দিনে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় দক্ষিন বাদাঘাট ইউনিয়নের পুরানগাঁও গ্রামের হযরত আলীর স্ত্রী শাহানা বানু (৩৫), একই উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের ক্ষিরদরপুর গ্রামের সুরমা বেগম(২২), দোয়রা বাজার উপজেলার মান্নারগাঁও ইউনিয়নের ডুববন্ধ গ্রামের আরশাদ আলীর ছেলে ফেরদৌস (১২), দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নেরটংগর গ্রামের মৃত ফজর আলীর ছেলে মুসলিম উদ্দিন (৭৫) মারা যান।
৯ মে বুধবার সকালে শাল্লা উপজেলার কালিয়াকুটা হাওরে ধান কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে নিহত হন আলমগীর হোসেন (৩২), তিনি উপজেলার কাশীপুর গ্রামের ইসহাক মিয়ার ছেলে। একই সময়ে ধর্মপাশা উপজেলার কালনী হাওরে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে উজ্জল মিয়া (১৫) নিহত হয়েছে। তিনি উপজেলার দূর্বাকান্দা গ্রামের রহিম উদ্দিনের ছেলে। সবাই নিজ হাওরে বজ্রাঘাতে মারা যান।
বজ্রপাতে আহতরা হলেন, জামালগঞ্জের সৈকত তালুকদার (১৫), তার সহোদর পিংকু তালুকদার (২৫) ও একই গ্রামের জ্ঞান তালুকদার (৪৫)। তাহিরপুর উপজেলায় শনির হাওরে পাশ্বভর্তি ইউনিয়ন বাদাঘাট থেকে ধান কাটতে আসা শ্রমিক লিয়াকত মিয়াসহ ১৬ জন।
পিযুস পুরকাস্থ টিটুসহ জেলার হাওরপারের কৃষক ফেরদৌস আলম, সাদেক আলী, সবুজ মিয়াসহ কৃষকেরা বলেন, এবার জেলার প্রতিটি হাওরেই বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তবে আবহাওয়ার বৈরী আচরণে আমরা আবারও চিন্তার মধ্যে আছি। বজ্রপাত ও বৃষ্টি হলেই আতঙ্কের মধ্যে থাকি। পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভাঙার ভয়ে। আর বজ্রপাতের ভয়ে শ্রমিকরা ধান কাটতে যেতে চায় না।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল জানান, প্রকৃতির বৈরী আচরণ হাওরপারে কৃষকেরা নিজেদের মতো করে পরিবারে লোকজন নিয়েই পাকা বোরো ধান কেটে শেষ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বজ্রপাত তারা সবসময় দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে। বজ্রপাত প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া খুবই প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
সুনামগঞ্জ সিভিল সার্জন আশুতুষ দাস বলেন, জেলার প্রতিটি উপজেলার এখন প্রয়োজনীয় গাছ নেই যা পূর্বে ছিল। যার ফলে বজ্রপাতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। বজ্রপাতে আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সিলেট পাঠানো হয়।
সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার বরকত উল্লাহ খানঁ বলেন, হাওরগুলোতে তালগাছসহ বেশি পরিমাণে গাছ লাগানো দরকার। আকাশে মেঘাচ্ছন্ন থাকলে সর্তকতা অবলম্বন করে নিরাপদ স্থানে থাকা ও সবাই সচেতন হলে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাবিরুল ইসলাম বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয় বজ্রপাতের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। মানুষকে সচেতন করার নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বজ্রপাত নিরোধে বিগত মৌসুমে এই জেলায় ৩০ হাজারের মতো তাল গাছ রোপন করা হয়েছে।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ