২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৪:৩৪

স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নাই

মহিউদ্দিন খান মোহন
শিরোনাম দেখে যে কেউ ভাবতে পারেন, এ নিবন্ধের লেখক প্রখ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেনের কালজয়ী কলাম-‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ এর অনুকরণ করেছেন। ভাবনাটি অমূলক নয়। কেননা, যে পরিবেশ- পরিস্থিতিতে তিনি ওই শিরোনামে কলামটি লিখেছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতিকে তারচেয়ে ভালো বলা যায় কী। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যেমন পথে-ঘাটে মানুষ খুন হতো, এখনও তেমনি হরহামেশা এখানে সেখানে পড়ছে মানুষের লাশ। যে জীবন্ত মানুষটি ঘর থেকে বের হয়ে যায়, ফিরে আসে তার নিষ্প্রাণ দেহ। নিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করেছে সমাজের প্রতিটি মানুষকে। একটা অজানা আতঙ্কে আচ্ছন্ন সবাই । অবশ্য যারা বডিগার্ড বা গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করেন, তাদের কথা আলাদা।
গত ৩ মে পার্বত্য রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা নিজ কার্যালয়ের সামনে খুন হয়েছেন দুর্বৃত্তদের গুলিতে। তিনি জনসংতি সমিতি (এমএন লারমা গ্রুপের) কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ছিলেন। এ হত্যকান্ডের জন্য সংগঠনটি ইউপিডিএফ নামের আরেকটি সশস্ত্র সংগঠনকে দায়ি করেছে। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, অফিসে প্রবেশের মুখে ওৎ পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। ঘটনাস্থল থেকে নানিয়ারচর থানার দূরত্ব মাত্র এক শ’ গজ। থানার এত কাছে দুর্বৃত্তরা একটি হত্যাকান্ড ঘটানোর সাহস কী করে পেল, এটা ভেবে চিন্তিত সবাই। পত্রিকার খবরেই বলা হয়েছে- থানার এত সন্নিকটে সংঘটিত এ হত্যকান্ড নানিয়ারচর উপজেলাবাসীকে আতঙ্কিত করে তুলেছে জননিরাপত্তা নিয়ে।
একই দিনে আরেকটি রোমহর্ষক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলায়। সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ওইদিন বেলা দুইটার দিকে উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় যোগদান শেষে মোটর সাইকেলে নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন বাঁশগাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল হক। কিন্তু বাড়িতে ফিরে আসা হয়নি তার। পথিমধ্যে আলীনগর নামক স্থানে তাকে মোটর সাইকেল থেকে নামিয়ে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত সিরাজুল হক বাঁশগাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের পাঁচবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। ধারনা করা হচ্ছে, পূর্ব শত্রুতার কারণেই তিনি নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন।
একই দিনে প্রকাশ্য দিবালোকে দুইজন জনপ্রতিনিধির এভাবে খুন হওয়ার ঘটনা কেউই মেনে নিতে পারছেন না। যদিও ঘটনা দু’টি দেশের দুই প্রান্তের এবং একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে, যুগপৎ এ জোড়া খুন একটি বিষয়কে আবারো সামনে নিয়ে এসেছে, সে সাথে তুলে ধরেছে কিছু প্রশ্ন। উল্লিখিত দু’টি খুনের ঘটনার একটি জায়গায় মিল রয়েছে। তা হলো দু’টি হত্যাকান্ডই ঘটেছে দিনদুপুরে। অর্থাৎ, আমদের দেশে এখন দিনেও মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। যে কেউ যে কোনো সময় আততায়ীর হাতে জীবন হারাতে পারে।
এদিকে গত ৪ মে রাঙামাটির নানিয়ার চরেই ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছে পাঁচজন। এরা আগেরদিন সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। খবরে বলা হয়েছে- নানিয়ারচরের সাবেক্ষং ইউনিয়নের তেছড়ি এলাকায় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি গুলিতে এই পাঁচজন নিহত হন। উপর্যুপরি দুই দিনে অর্ধ ডজন খুনের ঘটনা পার্বত্য এলাকা আবারো অশান্ত হয়ে উঠার আলামত বলে মনে করছেন সচেতন মহল। শান্তি চুক্তি সম্পাদনের পরেও যে পার্বত্য এলাকায় শান্তি ফিরে আসেনি এ ঘটনা তারই প্রমান।
এরই মধ্যে আমাদেরকে জানতে হলো আরেকটি নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা। গত ৭ মে বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার আটমূল ইউনিয়নের ডাবুইর এলাকার এক ধানক্ষেত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে হাত পা বাঁধা গলাকাটা চারটি লাশ। নিহতদের মধ্যে তিনজনের পরিচয় জানা গেছে। খবরে বলা হয়েছে, এরা নি¤œ আয়ের কর্মজীবী মানুষ। তবে এদের মধ্যে এক দু’জন মাদক ও জুয়া ব্যবসায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল বলে স্থানীয়রা পুলিশকে জানিয়েছেন। ধারনা করা হচ্ছে, অবৈধ ব্যবসায়ের লেন-দেন বা দেনা-পাওনা সঙক্রান্ত বিরোধের কারণে এ বর্বরোচিত হত্যাকা- ঘটে থাকতে পারে। পুলিশ বলেছে, ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। হত্যাকারিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
এমন খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। রাস্তার পাশে, নদীর ধারে কিংবা ঝোঁপ-জঙ্গলে অজ্ঞাত পরিচয় মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। কারো পরিচয় পাওয়া যায়, কারোটা পাওয়া যায় না। যাদের পরিচয় পাওয়া যায় তাদেরকে স্বজনরা নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ি সৎকার করার সুযোগ পায়। কিন্তু যাদের পরিচয় পাওয়া যায় না, তাদের সৎকার হয় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে। সৃষ্টির সেরা জীব একজন মানুষের জন্য এটা যে কত দুর্ভাগ্যজনক সেটা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না।
দুর্ভাগ্য আসলে এ জাতির। আমরা শান্তির সন্ধানে এখানে সেখানে প্রতি মুহূর্তে দৌঁড়ঝাঁপ করি। কিন্তু সে সোনার হরিণ ধরা দিচ্ছে না। রাজনীতিকরা আমাদের শান্তির বাণী শোনান, আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে অপেক্ষার কথা বলেন। একটি সুখি, সমৃদ্ধ ও শান্তিময় বাংলাদেশের কথা তারা বলেন। ‘আমরা ক্ষমতায় গেলে দেশবাসীর কোনো চিন্তা থাকবে না, ভয় থাকবে না, সন্ত্রাস যাবে কর্পুরের মতো উবে, জনজীবন হবে নিঃশঙ্ক’ ইত্যাদি সব আশা জাগানিয়া বাণী আমরা প্রায়ই শুনি। শুনি আর আশায় বুক বাঁধি। এই বুঝি শান্তি-সুখের পায়রা উড়ে এস বসবে আমাদের ঘরের চালায়। কিন্তু সে শ্বেতকপোত আর আসে না। তার পরিবর্তে আসে অশান্তির লু হাওয়া। আসে সন্ত্রাস নৈরাজ্যের প্রবল দাপুটে ঝড়ের খবর। সে ঝড়ো হাওয়া বয়ে নিয়ে আসে এখানে সেখানে পড়ে থাকা ভাগ্যাহত মানুষের লাশের খবর।
পৃথিবীতে সন্ত্রাসী দুর্বৃত্তদের হাতে মানুষ খুন হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। আমাদের দেশেও এ ঘটনা বহুকাল আগে থেকেই ঘটে আসছে। তবে, বিশ্বের অন্যান্য দেশে দুর্বৃত্তদের দমন করে জনজীবনে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা বিধানের যে উদ্যোগ সরকারকে নিতে দেখা যায়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে তার কিঞ্চিৎমাত্রই লক্ষ্য করা যায়। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনীর বিরুদ্ধে যখন গুম খুনের অভিযোগ উঠে, তখন অর বাকী থাকে কী? গণমাধ্যমে এ ধরণের অপহরণ, গুম আর খুনের খবর হরহামেশাই উঠে আসছে।এই তো ক’দিন আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি সংগঠনের উদ্যোগে খুন-গুমের ওপর গণশুনানি হয়ে গেল। সেখানে এসেছিলেন স্বজনহারা মানুষেরা। বলেছেন তাদের বেদনার কথা। তাদের বক্তব্যে স্বজন হারানোর বেদনার পাশাপাশি সরকারের প্রতি ক্ষোভের কথাও ছিল। উপস্থিত প্রায় সবাই গুম খুনের জন্য সরকারি বাহিনীর দিকেই তাদের অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন। তাদের এ অভিযোগকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। কারণ, ‘সাদা পোশাকের বিশেষ বাহিনী’র নামে যাদেরকে ধরে নেয়া হয়, তাদের অনেকেই আর ফিরে আসে না। যারা ফিরে আসে তারা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মুখ খোলে না। ফলে এসব অপহরণ গুম সম্পর্কে মানুষের মনে সৃষ্টি হচ্ছে নানা প্রশ্নের। তবে, সেসব প্রশ্নের কোনো জবাব কেউ দিচ্ছে না।
মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি নেই এটা চিরন্তন সত্য। যে কেউ যে কোনো সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। তাছাড়া মানুষের জীবনে অনেক বিষয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও মৃত্যুর নিশ্চয়তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে-‘কুল্লে নাফছিন যায়েকাতুল মউত।’ অর্থাৎ সব প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। সবকিছু থেকে রেহাই পাওয়া গেলেও মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই মিলার কোনো সুযোগ নেই। কবি বলেছেন-জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা রবে। কবিগুরু তার কবিতায় বেঁচে থাকার আকুলতা প্রকাশ করেছিলেন এই বলে-‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভূবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’। তিনি অবশ্যই মানবের মাঝে এখনও বেঁচে আছেন। তবে, তা তার কালজয়ী সৃষ্টির মাধ্যমে। কিন্তু বিশ্ব¯্রষ্টার অমোঘ নিয়মের বাইরে গিয়ে তিনি বাঁচতে পারেন নি। তাকেও মৃত্যর কাছে আত্মসমর্পন করতে হয়েছে।
মানুষ মরণশীলÑ এটা চিরন্তন সত্যের অন্যতম। তবে, সে মৃত্যু যদি হয় স্বাভাবিকভাবে, অর্থাৎ রোগ-ব্যধিতে ভুগে, পরিণত বয়সে, আফসোস তেমনটি হয়না। স্বজনরা ব্যথিত হন, কান্নার রোল উঠে, ভারাক্রান্ত হয় প্রতিবেশীদের হৃদয়। তারপর স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে সবাই মেনে নেন। কিন্তু একজন তরতাজা মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে যখন লাশ হয়ে ফিরেন, তা কি মেনে নেয়ার মতো? স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু বরণের এই যে অনিশ্চয়তা এটা কি কোনো সুস্থ সমাজের নিদর্শন? কেউ কেউ বলতে পারেন, সমাজ থেকে অপরাধ একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়। মানবারণ্যে কিছু দ্বিপদ হিং¯্র প্রাণী তো জন্ম নিতেই পারে। হ্যাঁ, তা পারে। গাছ থাকলে আগাছাও জন্মাবে এটা ঠিক। তবে, সে আগাছা যদি পুরো বাগানকে গ্রাস করে ফেলে, সমস্যাটা হয় তখনই। আর সে জন্যই আগাছা নির্মূলের ব্যবস্থা নিতে হয়। কিন্তু সে ব্যবস্থা কি সঠিকভাব নেয়া হচ্ছে?
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দায়িত্বশীলরা অনেকেই দ্বিধায় পড়ে যাবেন হয়তো। কেননা, তারা এটা নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না, সমাজের মধ্যে বেড়ে ওঠা দুর্বৃত্ত নামের সেসব আগাছা নির্মূলে তারা কতটা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পেরেছেন। বরং সমাজের ওপরতলা থেকে ওইসব আগাছাকে তরতর করে বেড়ে ও্ঠার সুযোগ করে দেয়ার নজিরের অভাব নেই। একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী বা মাদক ব্যবসায়ীকে যখন প্রভাবশালীদের পাশে বসে থাকতে বা চলাফেরা করতে দেখা যায়, তখন বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় কেন সমাজটা শ্বাপদ-সংকুল অরণ্যের মতো হয়ে গেছে, কেন মানুষ শান্তিতে স্বস্তিতে বসবাস করতে পারছেনা, কেন মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিন দিন কমে আসছে।
সমাজ নিয়ে কম-বেশি সবাই ভাবেন। ভাবতে বাধ্য হন। প্রত্যেকে নিজের জন্যই ভাবেন। প্রতিটি নাগরিক আজ উৎকন্ঠিত, শঙ্কিত। আমাদের এই সুন্দর দেশটি ক্রমশ যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। নির্ভয়ে কেউ আর চলতে বলতে পারে না। সদা ভয়, সদা আতঙ্ক। জীবনের অনিশ্চয়তা প্রতিটি মানুষকে বিচলিত করে তুলেছে। সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল যে তরুণী মেয়েটি, সন্ধ্যায় ইজ্জত-সম্ব্রম নিয়ে অক্ষত দেহে সে ফিরে আসতে পারবে কীনা, এ শঙ্কায় ভোগেন প্রতিটি বাবা-মা। স্বীকার করতে লজ্জ্বা থাকার কথা নয়, আমরা এ সমাজকে মানুষের অভয়ারণ্য বানাতে পারি নি। বরং আমাদেরই কারণে তা দিন দিন হয়ে উঠছে দুর্বৃত্ত-অপরাধীদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র। আর মানুষের জীবন হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত। সে সাথে সংকুচিত হয়ে আসছে মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার।
লেখক: সাংবাদিক।

প্রকাশ :মে ১০, ২০১৮ ১:৩৭ অপরাহ্ণ