অনলাইন ডেস্ক:
মুসলমানদের জন্য ‘অতি পবিত্র রজনী’ হিসেবে পরিচিত শবে বরাত। বাংলাদেশে শবে বরাতের রাতে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই মসজিদে প্রার্থনা করবেন।
এর সাথে আরেকটি বহুল প্রচলিত এবং গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে, বাড়িতে হালুয়া-রুটি তৈরি এবং প্রতিবেশীদের মাঝে সেটি বিতরণ।
বাংলাদেশের সমাজে শবে বরাতের প্রসঙ্গ আসলেই অবধারিতভাবে হালুয়া-রুটি তৈরির বিষয়টি চলে আসে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হালুয়া-রুটি তৈরির এ সংস্কৃতি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে কিভাবে চালু হয়েছে?
ইসলামের ইতিহাস যারা বিশ্লেষণ করেন, তাদের অনেকেই মনে করেন যে বাংলাদেশের সমাজ বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর অংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপক মুহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, এয়োদশ শতাব্দীতে ভারতের দিল্লীতে ইসলাম রাজনৈতিকভাবে আসে।
সে সময় তৎকালীন বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডেও ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব হয়।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ‘রসুলউল্লাহ (সা) সাহাবাদের যুগেও এ উপমহাদেশে তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা সুদূর আরব থেকে ইসলাম যে বিভিন্ন দেশে এসেছে, এগুলোর সাথে কিছু-কিছু দেশজ উপাদান যুক্ত হয়েছে। আমরা জানি যে রসুলউল্লাহ (সা) মিষ্টি খুব পছন্দ করতেন। তাঁর পছন্দের জিনিসকে উম্মতরা পছন্দ করবে সেটাও তাকে পছন্দ করার একটি ধরন। ফলে মিষ্টির একটা জনপ্রিয়তা মুসলিম সমাজে আছে।’
তিনি মনে করেন, শবে বরাতের সময় হালুয়া-রুটি বানানো এবং বিতরণ করার সাথে আনন্দ ভাগ করে নেবার একটি সম্পর্ক আছে।
‘আনন্দের ভাগটা অন্যদের দেয়ার জন্যই বিতরণ করার রেওয়াজটা হয়েছে। এর সাথে ধর্মীয় অনুভূতি এবং সামাজিকতা রক্ষা- দুটো বিষয় জড়িত আছে,’ বলেছেন অধ্যাপক ইব্রাহিম।
যেহেতু হালুয়া বানানোর উপাদান বাংলাদেশে আছে সেজন্য সেটি এসেছে। মূলত; মিষ্টি অর্থেই হালুয়ার প্রচলন হয়েছিল। বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে শবে বরাত পালনের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয় উনিশ শতকের শেষের দিকে। তখন ঢাকার নবাবরা বেশ ঘটা করেই শব-ই-বরাত পালন করতেন, বলছেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন।
তিনি বলেন, সে সময়ে ঢাকার নবাবরা শব-ই-বরাতের সময় আলোকসজ্জা করতো। এরপর পাশপাশি মিষ্টি বিতরণ করতো।
ইতিহাসবিদদের মতে সে সময়ে যেহেতু মিষ্টির দোকান খুব একটা প্রচলিত ছিলোনা, সেজন্য মিষ্টি জাতীয় খাদ্য বানানোর উপাদান দিয়ে বাড়িতে হালুয়া তৈরির প্রচলন শুরু হয়।
ধীরে-ধীরে এর বিস্তার ঘটতে থাকে।
ঢাকার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন অধ্যাপক মামুন। তিনি বলেন, সে সময়ে হিন্দুদের আধিপত্য থাকার কারণে সেটিকে মোকাবেলা জন্য ঢাকার নবাবরা শব-ই-বরাত জন্য অনেক বড় আয়োজন করতো।
এতে ঢাকার নবাবদের মুসলমান পরিচয় এবং আধিপত্য- এ দুটো বিষয় একসাথে তুলে ধরার প্রয়াস দেখা যেত।
অধ্যাপক মামুন বলেন, নবাবরা যেহেতু মুসলিম ছিলেন এবং ঢাকাকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতেন, সেজন্য উৎসবগুলোকে তারা গুরুত্ব দিতেন। এর মাধ্যমে নবাবদের আধিপত্য, মুসলমানদের আধিপত্য এবং ধর্ম পালন এই তিনটি বিষয় একসাথে প্রকাশ হতো।
উনিশ শতকের শেষের দিকে ঢাকায় শব-ই-বরাত পালন মুসলিম পরিচয় প্রকাশের বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। এমনটাই বলছেন অধ্যাপক মামুন।
সেই ধারাবাহিকতায় শব-ই-বরাত একটি বড় ধরনের উৎসবে পরিণত হয়েছে।
পাকিস্তান আমলে এর সাথে সরকারি ছুটি যুক্ত হওয়ায় সেটি পালনের ব্যাপকতা আরো বেড়েছে বলে অধ্যাপক মামুন উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, একটা সময় ছিলো যখন ঢাকায় শবে বরাত পালনের বিষয়টি ছিল সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে। ইতিহাসবিদদের মতে, বর্তমান বাংলাদেশে শবে বরাত পালন ধর্ম এবং সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। শবে বরাতকে কেন্দ্র করে ঢাকার বিভিন্ন দোকানে নানা ধরনের মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরি হয়।
মুসলমানদের মতে, শবে বরাতের রাতে পরবর্তী এক বছরের ভাগ্য নির্ধারিত হয়।
শবে বরাত নিয়ে অনেক ধারণা প্রচলিত আছে । এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো খাওয়া-দাওয়া।
বাংলাদেশের সমাজে অনেকেই মনে করেন, শবে বরাতের রাতে হালুয়া এবং রুটি তৈরি বাধ্যতামূলক। এছাড়া খাবারে মাছ কিংবা মাংস পরিবেশন করাকে অনেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশে হালুয়া-রুটির সংস্কৃতি চলে আসছে। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে এটি খাওয়ার সাথে শবে বরাতের জন্য বাধ্যতামূলক নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। বিবিসি বাংলা
দৈনিক দেশজনতা /এন আর