২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৮:৪৪

পাচার হওয়া টাকার ৮০ শতাংশই যাচ্ছে ব্যাংকের মাধ্যমে: বিআইবিএম

অর্থনীতি ডেস্ক :
বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকার ৮০ শতাংশই হচ্ছে ব্যাংকের মাধ্যমে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, চার কৌশলে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে অর্থ পাচার। এই অর্থ পাচারের বড় অংশ হচ্ছে ব্যাংকের মাধ্যমে। আমদানি-রফতানিতে পণ্য ও সেবায় ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং; আমদানি- রফতানিতে বহুমাত্রিক ইনভয়েসিং; পণ্য ও সেবা সম্পর্কে মিথ্যা বর্ণনা। একইভাবে শিপমেন্টের ক্ষেত্রেও ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে।

মঙ্গলবার (২৪ এপ্রিল) প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএম অডিটোরিয়াম এবং বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম অফিসে ‘ট্রেড সার্ভিসেস অপারেশনস অব ব্যাংকস’ শীর্ষক  বার্ষিক পর্যালোচনা কর্মশালায় প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের অধ্যাপক এবং পরিচালক (ট্রেনিং)  ড. শাহ মো. আহসান হাবীবের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল।

কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এবং বিআইবিএমের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান। এছাড়া, আরও উপস্থিত ছিলেন বিআইবিএমের মুজাফফর আহমেদ চেয়ার প্রফেসর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বরকত-এ-খোদা, পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমদ চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক মূল্যায়ন এবং অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অধিদফতরের কমিশনার ড. মঈনুল খান এবং এইচএসবিসি ব্যাংকের গ্লোবাল ট্রেড অ্যান্ড রিসিভেবলস ফাইন্যান্সের কান্ট্রি হেড মোহাম্মদ শহিদুজ্জামান। কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরী।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অর্থায়নে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের আধিপত্য বেশি। ২০১১ সালে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে রফতানি হয় ৭১ শতাংশ। সেই সময় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে হয়েছিল ১৮ শতাংশ। অবশিষ্ট বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ২০১৭ সালে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে রফতানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকের কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ শতাংশে।

কর্মশালার উদ্বোধন করে ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ট্রেড সার্ভিসের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিটি দেশে ট্রেড সার্ভিসের ক্ষেত্রে আলাদা রেগুলেশন রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরাও নতুন গাইডলাইন করতে যাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে ব্যবসাভিত্তিক অর্থ পাচার বাড়ছে। তবে অর্থ পাচার প্রতিরোধে কাজ করছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফইউ)। গত বছর থেকে ব্যাংকের সব কর্মকর্তাদের মানিলন্ডারিং বিষয়ে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে।’ এসময় এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার ক্ষেত্রে  আমদানিকারকদের সবকিছু যাচাই-বাছাই করতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

বিআইবিএমের গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যেসব পণ্য আমদানিতে কম শুল্ক দিতে হয়, বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রাংশ, শিল্পের কাঁচামাল এবং খুচরা যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে বেশি মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচার করা হয়। আবার সরকারি প্রণোদনা পেতে রফতানি পণ্যে বেশি মূল্য দেখানো হয়। বৈদেশিক বাণিজ্যের পাওনা পরিশোধে অসামঞ্জস্যতা প্রমাণ করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং শুল্ক বিভাগের যৌথ উদ্যোগে অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম অর্থ পাচার প্রতিরোধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

বিআইবিএমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে ইউএন কনভেনশন গ্রহণ করা প্রয়োজন। এছাড়া, অর্থ পাচার ঠেকাতে এলসি ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

বিআইবিএমের চেয়ার প্রফেসর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বরকত-এ-খোদা বলেন, ‘অর্থ পাচার বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেও অর্থ পাচার ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশকেও অর্থ পাচারের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে অর্থ পাচার কমিয়ে আনতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘টাকা পাচার ঠেকাতে আইন-কানুন এবং বিধির কোনও ঘাটতি নেই। কিন্তু অভাব শুধুই সততার। এ কারণে বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।’

পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘এলসি গ্যারান্টি ও ফি কমানোর জন্য বাংলাদেশকে ভিয়েনা কনভেনশনের সদস্য হওয়া উচিত। কেননা, আমাদের বেশিরভাগ রফতানি হয় ইউরোপ ও আমেরিকাতে। ভিয়েনা কনভেনশনের সদস্য হলে এসব ফি কমবে এবং এলসির গ্যারান্টি নিশ্চিত হবে। কারণ, বিশ্বের ৮৯টি দেশ ভিয়েনা কনভেনশনের সদস্য।’

এনবিআরের কাস্টমস ভ্যালুশন অ্যান্ড ইন্টারনাল অডিট কমিশনারেটের কমিশনার ড. মঈনুল খান বলেন, ‘অর্থ পাচারের ৮০ শতাংশই ট্রেডের মাধ্যমে হচ্ছে। বর্তমানে এটা প্রতিরোধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বাণিজ্যভিত্তিক অর্থ পাচার বন্ধ করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘অর্থ পাচার বন্ধে এলসি খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তারা জড়িত হয়ে পড়ে। ব্যাংকগুলোকে অর্থ পাচারের কৌশল তদারকি করতে হবে। এক্ষেত্রে কাস্টমসের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর সমন্বয় দরকার। ৬৩৪টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে কাস্টমস। এই এসআরও ব্যাংকগুলো সংগ্রহ করতে পারে। তাহলে এলসি করার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলি বলেন, ‘এটি খুবই আশঙ্কার বিষয়, ৮০ শতাংশ অর্থ পাচারই ব্যাংকের মাধ্যমে হয়। শুধু অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকগুলো সমস্যায় আছে। এই সমস্যা সমাধানে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘ঋণের সুদহার কমানোর কথা বলা হচ্ছে। ঋণের সুদহার কমালে আমানতের সুদহারও কমবে।’

দৈনিক দেশজনতা/ টি এইচ

প্রকাশ :এপ্রিল ২৪, ২০১৮ ৭:৪০ অপরাহ্ণ