ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি:
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গ্রাহকদের সঙ্গে চলছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) মশকরা। সপ্তাহে প্রায় ৭ দিনই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দৈনিক কমপক্ষে ১২ থেকে ১৫ বার বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঈদগাহ ফিডার এলাকা সর্বশেষ সোমবার রাত ৯টা থেকে মধ্যরাত ১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বন্ধ থাকে। বিশেষ করে ঈদগাহ ফিডার ও পাইকপাড়া ফিডারসহ কয়েকটি ফিডারের গ্রাহক দুর্ভোগ সীমাহীন। বিদ্যুৎহীন থাকায় অন্ধকারে মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়ালেখা করতে হচ্ছে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের। রোগী ও বৃদ্ধরা গরমে কষ্ট করছেন। বৃষ্টি নয় যদি বৃষ্টির ভাব হলে অকারণেই বন্ধ করে রাখা হয় বিদ্যুৎ। ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টি হলে টানা ৪/৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ করে রাখা হয়।
এর কারণ জানতে গ্রাহকেরা কোনো প্রকার উত্তর খুঁজে পান না। বিদ্যুৎ বন্ধ করার সাথে সাথে বন্ধ করে রাখা হয় গ্রাহক অনুসন্ধান কেন্দ্রের মোবাইল ফোন ও উঠিয়ে রাখা হয় টেলিফোনের রিসিভারও। পাশাপাশি বন্ধ পাওয়া যায় সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্ব প্রাপ্ত সহকারী প্রকৌশলীদের মুঠোফোন নম্বর। আর বিদ্যুৎ উন্নয়ন ও বিতরণ বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী জানালেন তিনি এসবের কিছুই জানেন না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে আবাসিক প্রায় ৫০ হাজার ও বাণিজ্যিক ১০ হাজার গ্রাহক রয়েছে। জেলা সদরকে ভাগ করা হয়েছে ১২টি ফিডারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন কয়েকজন প্রকৌশলী দীর্ঘদিন যাবত একই জায়গায় রয়ে গেছেন। তাদের খেয়াল খুশি মত চলে গ্রাহকদের সেবা প্রদান। তারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অবৈধ অটো রিকশা গ্যারেজ, ধান ভাঙার মিল ও বয়েলারে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে রেখেছেন। এসব অবৈধ সংযোগের কারণে বরাদ্দকৃত বিদ্যুতের চাইতে চাহিদা অনেক গুন বেড়ে যাওয়ায় ঘটতি পূরণে কারণে অকারণে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সম্প্রতি অটোরিকশা গ্যারেজে খুঁটি থেকে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার ও চুরির ঘটনায় ৪ প্রকৌশলীকে শোকজ এবং তিরস্কার করেছে কুমিল্লাস্থ বিদ্যুৎ আদালত। কুমিল্লাস্থ বিদ্যুৎ আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোজাহিদুর রহমান এর আদালতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের সহকারী-প্রকৌশলী শওকত আলী, সহকারী প্রকৌশলী হেবজুল বারী, উপ-সহকারী রাসেল সরকার, উপ-সহকারী নাসির উদ্দিন তাদের আওতাধীন এলাকায় অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য কারণ দর্শাতে আদালতে হাজির হলে আদালত তাদের তিরস্কার করেন।
তাদের এই সিন্ডিকেটে লাইনম্যান ও ইলেক্ট্রিশিয়ানরাই প্রকৌশলীদের মূল হাতিয়ার। টাকার বিনিময়ে সেবা ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিতরণ বিভাগে অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। নতুন সংযোগ প্রদান, লাইন মেরামত, মিটার পরিবর্তন, বিল প্রদানসহ সব ক্ষেত্রেই গ্রাহকদের কাছ বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। সরকারি নির্ধারিত খরচের চেয়ে দুইগুণ বেশি টাকা নিয়ে নতুন অবৈধ সংযোগের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন তারা।
৮ মার্চ ভ্রাম্যমাণ আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুজাহিদুর রহমান সাদেকপুর-বড়াইল ফিডারের লাইনম্যান ও ইলেক্ট্রিশিয়ান শাহজাহান মিয়া, মিলন মিয়া ও জাহের মিয়া বাড়িতে অভিযান চালায়। এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ৫৯টি মিটার, ৭৬টি অফিস ফাইল ও বিপুল পরিমাণ বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম উদ্ধার করে। জব্দকৃত মিটারের মধ্যে ১ লাখ ৫৪ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ চুরির প্রমাণ পেয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের কার্যালয়ে কর্মরত লাইনম্যান ও সিবিএ নেতা তার সরকারপাড়ায় একটি চারতলা ভবনে মিটারবিহীন সরাসরি সংযোগের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে আসছিলেন। দুই বছর ধরে অবৈধভাবে প্রায় ২১ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছেন। ২০১৭ সালের নভেম্বরের ৭ তারিখ ভ্রাম্যমাণ আদালত অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়ায় ও ব্যবহারের কারণে ওই নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এছাড়া একই দিন দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ বিল না দেওয়ায় দাতিয়ারা পিডিবি কলোনিতে বসবাসরত দুই লাইনম্যানের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধেও মামলা হয়।
জেলা শহরের পৈরতলার বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুতের যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ। এমনও দিন যায় ঘণ্টায় ৫ বার বিদ্যুৎ যায় আবার আসে। অভিযোগ কেন্দ্রে ফোন দিয়ে কোনো লাভ নেই। পৌর এলাকার ছয়বাড়িয়ার বাসিন্দা মুনির মিয়া বলেন, আজব যন্ত্রণায় আছি। সরকার রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে শুধু জনগণকে সেবা দিতে। অথচ ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিদ্যুৎ অফিসের কারণে আমরা এর সুফল পাচ্ছি না। শুধু কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কারণে আমরা চরম দুর্ভোগে পড়ছি।
এসব বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, এসব বিষয়ে অবগত নন। তিনি বলেন, এখানের বেশির ভাগ ট্রান্সফরমার পুরাতন ও ত্রুটিপূর্ণ। গরমকালে অতিরিক্ত চাহিদার কারণে ট্রান্সফরমার গুলো গরম হয়ে সমস্যা দেখা দেয়। তাই বিদ্যুতের সমস্যা দিতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই সমস্যাটি প্রতিদিন এক এলাকায় নয়, বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় হতে পারে। তবে ঈদগাহ ফিডারে কেন বিদ্যুৎ সমস্যা হচ্ছে তার দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রকৌশলী হেবজুল বারী ভাল বলতে পারবেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগে সহকারী প্রকৌশলী মো. হেবজুল বারীর মুঠোফোনে বার বার চেষ্টা করেও বন্ধ পাওয়া যায়।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি