নিজস্ব প্রতিবেদক:
শুকিয়েছে রক্তের দাগ কিন্তু শুকায়নি চোখের পানি। সেদিন জাতি দেখেছে ইতিহাসে বিবর্জিত এক কালো অধ্যায়, দেখেছে হাজারো লাশের স্তুপ। স্ত্রী হারিয়েছেন স্বামীকে, স্বামী হারিয়েছেন স্ত্রীকে, ভাইকে ফেরত না পাওয়ার বেদনায় কাতর বোন, বোনের লাশের প্রতীক্ষায় ভাই, সন্তানের মৃত্যু শোকে ব্যাকুল মা-বাবা।
ভয়াল সেই রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পঞ্চম বার্ষিকী আজ মঙ্গলবার। চার বছর আগে ২০১৩ সালের এই দিনে (২৪ এপ্রিল) প্রতিদিনের মত সকাল আটটার দিকে সাভারের রানা প্লাজার নয়তলা বিশিষ্ট ভবনে থাকা পাঁচটি পোশাক কারখানায় শ্রমিকরা প্রবেশ করেন। তারা কেউই জানতেন না কী ভয়াবহ পরিণতি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকাল আনুমানিক ৮ টা ৪৭ মিনিটে একযোগে চালু করা হয় ওই ভবনে থাকা ডজন খানেক জেনারেটর। জেনারেটর চালু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিকট আওয়াজে ধসে পড়ে ভবনটি। ভবনের ধ্বংসস্তুপ থেকে একে একে ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিকের লাশ বের করা হয়।
ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার পাঁচ বছর পারও দায়ের করা মামলাগুলোর কোনো অগ্রগতি নেই। প্রতি বছরে এই দিনটি এলেই শ্রমিক পরিবারের আহাজারিতে গুমরে গুমরে কাঁদতে থাকে মানবতা। নির্মম পঙ্গুত্ব বরণ করা শ্রমিকরা সুবিচার পাওয়ার আশায় থাকলেও ৫ বছরে অভিযুক্তদের বিচারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। অবহেলাজনিত মৃত্যু ও ইমারত নির্মাণ আইনে দায়ের করা দুই মামলাসহ ১৮টি মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। যার মধ্যে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২টা, যুগ্ম জেলা দায়রা জজ আদালতে ১টা, শ্রম আদালতে ১১টা আর হাইকোর্টে চারটা মামলা।
আইনজীবীরা বলছেন, সরকারি বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে মামলাগুলো গতি পায়নি।‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা’ মামলায় ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জন আসামির মধ্যে আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন নামে দুইজন মারা গেছেন। তাদের বাদ দিয়ে ৩৯ জন আসামির মধ্যে ৭ জন পলাতক রয়েছেন। বাকিরা সবাই জামিনে মুক্ত। মামলাটিতে সাক্ষী আছেন ৫৯৪ জন। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে মামলাটির বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত। কিন্তু অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আসামিপক্ষ হাইকোর্টে গেলে স্থগিত হয়ে যায় মামলাটির কার্যক্রম। উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে গত দুই বছরে সাক্ষ্যগ্রহণ করা যায়নি একজনেরও।
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি খন্দকার আব্দুল মান্নান বলেন, হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকায় আইনগত কারণেই মামলাটিতে সাক্ষ্য হচ্ছে না। প্রতি ধার্য তারিখেই সাক্ষীরা আদালতে আসছেন, কিন্তু সাক্ষ্য নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, মামলাটির অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আট আসামি হাইকোর্টে রিট করেন। এর মধ্যে সাতজনের পক্ষে স্থগিতাদেশ শেষ হয়েছে। বাকি রয়েছে একটি, সেটি ১২ মে শেষ হবে। এরপর আগামী ১৬ মে সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ রয়েছে, আশা করছি সেদিন থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করতে পারবো।
অন্যদিকে ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন সাভার থানায় একটি মামলা করেছিলেন। ওই মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। মামলায় সাক্ষী করা হয় ১৩০ জনকে। ২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। অভিযোগ গঠন হওয়ার পর থেকে এই মামলায়ও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।
এছাড়া রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধান বা সরকারি কর্মকর্তাদের পরিদর্শনে ব্যর্থতাসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগে শ্রম আদালতে যে ১১টি মামলা হয়েছে সেগুলোরও তেমন কোনো অগ্রগতির তথ্য জানাতে পারেনি শ্রম পরিদর্শন অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক সামছুজ্জামান ভুঁইয়া বলেছেন, মামলাগুলো বিচারাধীন আছে। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা ভিন্ন মামলায় সাজা হয়েছে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ও তার মা মর্জিনা বেগমের।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এই শিল্প দুর্ঘটনার বিচারকাজ থমকে থাকায় ক্ষোভ জানিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, এত বড় একটা ট্র্যাজেডির মামলা নিষ্পত্তি করতে আমি তেমন কোনো তৎপরতা দেখছি না। সরকারের বিভিন্ন আচরণে মনে হচ্ছে তারা আসামিদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার পর থেকে আমরা পোশাক শিল্পে নিরাপদ কর্ম পরিবেশ তৈরির দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকার সেটাও এখনো পুরোপুরিভাবে তৈরি করতে পারেনি।
নারী নেত্রী তাসলিমা আখতার বলেন, এত বড় ঘটনার পর যখন আইন ধীর গতিতে চলে তখন বুঝতে হবে সরকারের এখানে সদিচ্ছার অভাব আছে। এ কারণেই ৫ বছরেও বিচার তো দূরের কথা, সাক্ষ্যগ্রহণের বিষয়টিও অমিমাংসিত রয়ে গেছে। শ্রমিক অধিকার আদায়ের স্থানীয় নেতা মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, আমরা আশা করেছিলাম রানা প্লাজা ট্রাজেডি শ্রমিকদেরকে ইউনিয়নভুক্ত হতে সহায়তা করবে। তারা এক হয়ে তাদের উন্নত অধিকার আদায়ের দাবি তুলবে। কিন্তু ঘটেছে তার উল্টো। কোনো প্রতিবাদ বিক্ষোভের আভাস পেলেই কারখানা মালিকরা স্থানীয় গুণ্ডা, পুলিশদের ব্যবহার করে। সরকার চালায় দমনপীড়ন।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি