মারুফ শরীফ, নিজস্ব প্রতিবেদক :
বর্তমান সংসদ বহাল রেখে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সেটা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না বলে মতামত দিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীগণ।
তারা বলেছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ‘বর্তমান সংসদ বহাল রেখে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে’। যে সংসদে সরকারের এবং সরকার পক্ষীয় অত্যন্ত ক্ষমতাধর ৩৫০ জন এমপি আছেন, সেখানে একটি সুষ্ঠু বা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ-এর সেমিনার হলে এক মতবিনিময় সভায় উপস্থিত বুদ্ধিজীবীগণ এসব কথা বলেন।
‘অবাধ নিরপেক্ষ অর্থবহ নির্বাচন: নির্বাচনকালীন সরকার, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা যৌথভাবে আয়োজন করে সিপিবি ও বাসদ।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
সভায় পঠিত প্রবন্ধে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ১৮টি সুপারিশ পেশ করেন। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়া, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব রাখা, নির্বাচনি ব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার, প্রার্থীদের সম্পদ ও পরিচয় প্রকাশ, নির্বাচনে সবার সম-সুযোগ, সন্ত্রাস, পেশিশক্তির প্রভাব ও দুর্বৃত্তমুক্ত নির্বাচন, নির্বাচনে ধর্ম সাম্প্রদায়িকতা ও আঞ্চলিকতার অপব্যবহার রোধ, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক চর্চা, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধি অনুসরণ, নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন, প্রতিনিধি করার ব্যবস্থা প্রবর্তন, না ভোট পুনর্প্রচলন, ভোটার তালিকা ও সবার ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, নির্বাচনি এলাকা নির্ধারণ ও নির্বাচন পরিচালনায় হস্তক্ষেপ না করা, নির্বাচন কমিশন আইন ও বিধি সংস্কার।
সভায় বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র ইমিটেশন অলঙ্কারের মতো। আসল অলঙ্কার ও ইমিটেশন অলঙ্কারের মধ্যে তফাৎ রয়েছে। কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে যে সংসদ গঠন হয়, তা হচ্ছে মূল্যহীন ইমিটেশন অলঙ্কার। তাই মনে রাখতে হবে আমরা আসল অলঙ্কার চাই, ইমিটেশন অলঙ্কার চাই না।
মকসুদ আরও বলেন, ভালো নির্বাচন করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে গণতন্ত্রমনা ও শক্তিশালী হতে হবে। তাদের মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে। কারণ, একটি ভালো নির্বাচন জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। সংসদ বহাল রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন-এর সভাপতি এম. হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ক্ষমতাসীন দল থেকে বলা হচ্ছে ‘আগামী নির্বাচনে সংসদ বহাল থাকবে’। যেখানে ৩৫০ জন অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি উপস্থিত থাকবেন, সেখানে ভালো বা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়ার সুযোগ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি, আপনারাও এটা বিশ্বাস করেন না। আমরা এটা নির্বাচন কমিশনেও বলে এসেছি। এ ব্যাপারে কেউ কোনও কথাই বলছেন না।
হাফিজ আরও বলেন, সংসদ ভেঙে দেয়া হবে কি হবে না, এ ব্যাপারে সরকারের কোনও সাড়া নেই। এটা তো সংবিধান পরিপন্থী না। সংবিধানে সংসদ ভেঙে দেয়ার কথা পরিষ্কারভাবে লেখা আছে। সুতরাং, এটা করতে তো সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়ে যাবে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে’। সংবিধানে তো সংসদ ভেঙে দেয়ার বিরুদ্ধে কিছু বলা নেই। যেভাবে দেশে এখন নির্বাচন হচ্ছে, তাতে নিরপেক্ষ নির্বাচন আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
তিনি বলেন, একদল নির্বাচনের প্রচারণা চালাচ্ছে, আরেক দল ঘর থেকে বেরও হতে পারছে না। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশন বলছে, তফসিল ঘোষণার আগে আমাদের কিছুই করণীয় নেই। অথচ নির্বাচন কমিশন চাইলে এটা বন্ধ করতে পারে। তাদের সেই ক্ষমতা আছে।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট রানা দাসগুপ্ত বলেন, আগামী নির্বাচনের আর ছয় মাস বাকি আছে। এসময়ে এত বড় সংস্কার করা সম্ভব বলে আমি মনে করি না। এ সময়ের মধ্যে ছোট করে কী কী বিষয় সংস্কার করা যায়, তা আমাদের সবাইকে বসে ঠিক করতে হবে। আমাদের দেশে এখনও আমার ভোট আমি দেবো, এর বাস্তবায়ন হয়নি। কেউ যদি ধর্মের দোহাই দিয়ে ভোট চান, তাহলে প্রার্থিতা বাতিল করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে ধর্ম একটা নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম যার যার থাকবে। এটাকে রাজনীতি এবং সংববিধান থেকে বাদ দিতে হবে। আমাদের কাছে নির্বাচন মানে নির্যাতন। সে জায়গা থেকে বের হতে হবে।
বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বাম মোর্চার সমন্বয়ক শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, গণফোরামের নির্বাহী পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য, নাগরিক ঐক্যের নেতা এসএম আকরাম হোসেন, কাজল দেবনাথ প্রমুখ।
দৈনিক দেশজনতা/ টি এইচ