নিজস্ব প্রতিবেদক:
রমজানে ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়মিত ঘটনা। পাইকারি থেকে খুচরা ব্যবসায়ী পর্যন্ত সবাই একযোগে অর্থ উপার্জনের মাস হিসেবে রমজানকে বেছে নেয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আছেন যারা রমজান মাসে এতো বেশি লাভ করেন যা গোটা বছরের তুলনায় বেশি। রমজানে অধিকাংশ ভোগ্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক সময়ের দামের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ ভোক্তারা। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সারা বছরের তুলনায় রমজানে ব্যাপক পরিমাণে বেচাকেনা হওয়ায় প্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন উইং পণ্যের কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে।
রমজান ছাড়াও ভোগ্যপণ্যের স্বল্পকালীন সংকটে যে পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি পায় পরে তা আর আগের অবস্থায় ফিরে না। ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি স্থায়ী হওয়ার এটা একটা মূল কারণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমলেও তা মোট বৃদ্ধির অর্ধেকও নয়। বর্ধিত দামই স্থায়ী হয়ে যায়। এই মূল্য নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরের কোনো প্রস্তুতি নেই বললে চলে। দায় এড়িয়েই দায়িত্ব সারতে চান তারা।
এভাবে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দেয়া সর্বশেষ তথ্য মতে, ২০১৬ সালে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আগের চেয়ে বেড়েছে ৬.৪৭ শতাংশ। একইভাবে ২০১৫ সালেও আগের বছরের চেয়ে ৬.৩৮ শতাংশ বেশি খরচ করতে হয়েছিল প্রত্যেক নাগরিকের জীবন পরিচালনায়। জীবনযাত্রায় ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি। আর এ ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে উঠে আসে বেশ কিছু বিষয়-
১. পরিবহন খরচ বৃদ্ধি
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেশীয় ও সীমান্ত পার হয়ে আসা পণ্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পরিবহন করা হয়। এ পরিবহন খরচ বেড়ে এখন দ্বিগুণ হয়েছে। শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী ও বণিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ হাজী মোহাম্মাদ মোহসিন মিয়া বলেন, আমরা আগে যে ট্রাকে ২০ টন মালামাল বহন করতাম এখন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে প্রতি ট্রাকে মাত্র ১১ টন মালামাল বহন করতে হচ্ছে। এখানেই পরিবহন খরচ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এর প্রভাব অবশ্যই এবার ভোগ্যপণ্যের দামের উপর পড়বে।
২. পরিবহনে চাঁদাবাজি
দেশের উত্তারাঞ্চলসহ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভোগ্যপণ্য ভর্তি ট্রাকে পথে পথে চাঁদাবাজি নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে একটি সভা করা হয়েছে। সেখানে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, রাস্তায় চাঁদাবাজি বন্ধ হলে এবছর রমজানে অর্ধেক টাকা মূল্যে ভোগ্য পণ্য বিক্রি সম্ভব হবে। মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, রাস্তায় ও হাটে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারলে তিনশ’ টাকা কেজি দরে দেশী গরুর মাংস খাওয়ানো যাবে। বর্তমানে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে পাঁচশ’ টাকা কেজি।
৩. ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফা প্রবণতা
রমজানসহ বিভিন্ন সময় ভোগ্যপণ্যের হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির এটাও অন্যতম একটি কারণ উল্লেখ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. আব্দুর রব বলেন, এ বিষয়ে প্রয়োজন সঠিক মনিটরিং। তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি সিস্টেম গড়ে তোলা। তিনি বলেন, প্রতিটি বাজারে পুলিশ দিয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের ধরপাকড় করা সম্ভব নয়। গোটা ব্যবসায়িক সিস্টেমের পরিবর্তন হলে এ ধরনের প্রবণতা দূর করা সম্ভব।
৪. পণ্যের পাইকারি ও খুচরা বিক্রয় মূল্যের পার্থক্য
পাইকারি ও খুচরা মূল্যের পার্থক্য যত বেশি হবে ভোক্তার ঘাড়ে তত বেশি দামের ভাড় বৃদ্ধি পাবে। এটা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সরকারের প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. ইকবাল খান চৌধুরী বলেন, ঢাকায় অধিকাংশ মার্কেটের মালিক সিটি করপোরেশন। এসব দোকান সিটি করপোরেশন থেকে খুব কম মাসিক ভাড়ায় প্রভাবশালীরা নিয়ে চড়া ভাড়ায় খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে দ্বিতীয় ধাপে ভাড়া দেন। একারণে বাধ্য হয়েই খুচরা ব্যবসায়ীদের বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে হয়।
৫. ক্রেতাদের অধিক ক্রয় প্রবণতা
রমজান আসলেই ক্রেতাদের বেশি পরিমাণে কেনার প্রবণতা বেড়ে যায়। যার প্রয়োজন এক কেজি সে পাঁচ কেজি কেনে এবং পুরো রমজানজুড়ে তা কাজে লাগায়। একই পণ্য কয়েকবারে পরিমাণে কম কিনলে বাজারে চাহিদা কম থাকে এবং মূল্যেও ভারসাম্য রক্ষা হয়। এ বিষয়ে স্বয়ং বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যাতে ক্রেতারা একসঙ্গে বেশি পণ্য ক্রয় না করে।
৬. অপর্যাপ্ত বাজার মনিটরিং
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রুটিন ওয়ার্কের বাইরে বাজার মনিটারিংয়ের কাজ করার সুযোগ খুবই কম। ফলে বাজার কম মনিটরিংও খুচরা বাজারে ভোগ্যপণ্যের চড়া মূল্যের জন্য দায়ী বলে মনে করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র।
৭. ডলারের দাম বৃদ্ধি
আগে থেকে এলসি করা থাকলে হঠাৎ ডলারের মূল্য বৃদ্ধির ফলে ভোগ্যপণ্যের দামের উপর এর প্রভাব পরে। তাছাড়া এর খেসারত গুণতে হয় পাইকারী ব্যবসায়িদের। ফলে তারা বাধ্য হয়েই বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রয় করে।
৮. আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব
আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্য পণ্যের মূল্যের বৃদ্ধি হলে এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে দেখা গেছে। গত বছর ভারতের বেশকিছু প্রদেশে বন্যার ফলে পেঁয়াজ উৎপাদন ব্যাহত হয়। এতে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পায় বলে উল্লেখ করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এছাড়া বাজার বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ওপেন মার্কেট ইকোনোমিতে যেকোন পণ্যের দাম নির্ধারণ হয় বিক্রেতা এবং ক্রেতার দর কষাকষির মাধ্যমে। এখানে চাইলেই বিক্রেতা বা ক্রেতা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এখানে বিক্রেতা এবং ক্রেতার মাঝে দর কষাকষির মাধ্যমে নির্ধারিত হয় পণ্যের দাম। ক্রেতার যদি উক্ত দাম পছন্দ না হয় তাহলে সে অন্য কোথাও থেকে পণ্য ক্রয় করতে পারেন। তিনি যেখান থেকে কম মূল্যে একই পণ্য পাবে সেখান থেকে ক্রয় করবেন।
তারা মনে করেন, এবছর রমজানের পরিস্থিতি বিগত সময়ের মতো না হয় তাহলে তাহলে হয়তো ভোগ্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল থাকবে। তবে রোজা উপলক্ষে চাহিদা ও যোগানের একটি বিষয় থাকে। এসময় ছোলা, তেল ও ডালসহ কিছু কিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। আসলে বিশ্ববাজারেও এটা হয়। চাহিদা যখন বাড়বে তখন জিনিসপত্রের দামও বেড়ে যায়। এটাকে সরকার আইন করে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো সুযোগ নেই।
জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর বলেন, আমরা কাজ করি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে। এ অধিদফতরকে প্রাইজ ম্যাকানিজম করার কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি। ভোক্তার অধিকার বাস্তবায়নে আইনে স্বীকৃত নির্দেশনাগুলো লঙ্ঘন হচ্ছে কিনা এটা আমরা মনিটরিং করি। অনেক সময় এ ধরনের অপরাধে আমরা জরিমানাসহ কোর্টে মামলা করি। তবে এবার রমজানে ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে কিনা এটা এখনই বলা যাবে না বলে মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা।
খুচরা ব্যবসায়ীরা নিজেদের মতো করে খেয়ালখুশি মূল্য নির্ধারণ করে সাধারণ ভোক্তার কাছে বিক্রয় করে। এটা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আপনাদের। কিন্তু সেটা হচ্ছে না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, মূল্য তালিকা আইন আমাদের আইনেও আছে। তবে এ আইনটা মূলত সিটি করপোরেশনের। এ আইনে বলা আছে খোলাপণ্যের মূল্য তালিকা ঝুলিয়ে রাখতে হবে। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। যেখানে মূল্য তালিকা নেই সেখানে আমরা মাঝে মাঝে জরিমানা করি।
তিনি বলেন, দেখুন এ তালিকায় দোকানদার যেটা লিখে রাখবেন সেটা আমাদের মেনে নিতে হয়। সে যদি বেশি লিখে রাখে সেখানে আমাদের করার কিছু নেই। তবে ঝুলন্ত তালিকায় যে দাম লিখে রাখে তার চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করলে আমরা জরিমানা করতে পারি। কিন্তু খুচরা বিক্রেতা ক্রয় মূল্যের চেয়ে বেশি লভ্যাংশ যোগ করে ঝুলন্ত চার্টে লিখে রাখলে আমার অধিদফতরের আইনে কিছু করার নেই।
‘খুচরা বিক্রেতারা কত দামে কিনে কত দামে বিক্রয় করবে এর নির্দিষ্ট নির্দেশনাসহ কোনো আইন দেশে নেই। এই আইনটি করা সম্ভব হবে কিনা তাও আমার জানা নেই। কারণ আমাদের দেশ চলে এখন ওপেন মার্কেট থিওরিতে। এখানে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের জন্য মার্কেট ওপেন থাকে। গভমেন্ট কোন হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এটা দেখভাল করার জন্য সরকার বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করেছে। তারা এটা ভালো বলতে পারবে’ যোগ করেন এই কর্মকর্তা।
এবিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. ইকবাল খান চৌধুরী বলেন, দেখুন কে কত টাকা দিয়ে কোন পণ্য ক্রয় করেছে এবং কত টাকায় তা বিক্রয় করছে এটা মনিটরিংয়ের দায়িত্ব আমাদের কমিশনের নয়। তবে আমরা দেখি যেখানে ব্যবসায় প্রতিযোগিতা নেই সেখানে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা। প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে পারলে এমনিতেই পণ্যের দাম কমে আসবে। তিনি বলেন, আমরা ভোক্তা লেভেলে কাজ করি না। যখন কোনো পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তখন তা তদন্ত করি। যদি ধরা পড়ে সেখানে সিন্ডিকেট হচ্ছে, তখন এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আমরা অবস্থান নেই। এ সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে পারলেই পণ্যের দাম কমে যায়। পদ্ধতিগত হোক বা অন্য কোনো উপায়ে খুচরা পর্যায়ে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সহজে ভোগ্যপণ্যের মূল্যের উঠানামা থামানো সম্ভব নয়।
জানতে চাইলে পাইকারী পেঁয়াজ ব্যবসায়ী মের্সাস রফিক ট্রেডার্সের মালিক অতল বাবু বলেন, এবছর পাইকারী পর্যায়ে প্রচুর মালামাল মজুদ রয়েছে। আমরা কম মূল্যেই মাল ছাড়তে পারব। কিন্তু খুচরা বিক্রেতাদের উপরও অনেকটা নির্ভর করবে তারা কেমন দামে বিক্রি করে। আমাদেরকে ঢালাওভাবে না দুষে সরকারের প্রয়োজন খুচরা বিক্রেতাদের কার্যক্রম মনিটরিং করা।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি