২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১০:৪৪

রাজনৈতিক উদ্দেশে সিরিয়ায় হামলা: মার্কিন বিশেষজ্ঞ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

জাতিসঙ্ঘের হিসাবে সিরিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধে পাঁচ লাখের বেশি লোক নিহত হয়েছে। যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। এই নিহতদের মধ্যে ছোট্ট একটি অংশ নিহত হয়েছে বাশার সরকারের কমপক্ষে ৩৪টি রাসায়নিক গ্যাস হামলায়। তথাপি এই রাসায়নিক হামলাকেই বাশার সরকারের ‘সীমা অতিক্রম’ হিসেবে পশ্চিমারা কেন বিচার করছে সেটি বোঝা দায় হচ্ছে।

সিরীয় জনগণ বলছেন, সাতটি বছর ধরে ব্যারেল বোমা, কামান, ক্ষেপণাস্ত্রের গোলায় লাখ লাখ লোক নিহত হলেও এবার রাসায়নিক হামলাকেই উপলক্ষ বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা। সর্বশেষ রাসায়নিক হামলা হয়েছে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা দোমা শহরে। পূর্ব গৌতার এই শহরটি সর্বাত্মক হামলার পর দখল করে নিয়েছে সরকারি বাহিনী। এই শহরে রাসায়নিক হামলার পরই যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স বাশার সরকারের তিনটি রাসায়নিক অস্ত্রাগারে হামলা চালিয়েছে। এর অল্পক্ষণ পরই যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, বাশার সরকার যদি আবার রাসায়নিক হামলা চালায় তবে তারা আবারো হামলার জন্য প্রস্তুত। তবে সিরিয়ার জনগণ ট্রাম্পের এই হুমকিকে সন্দেহের চোখে দেখছে। ‘আগেই হামলা করা উচিত ছিল’ হামা প্রদেশের সমাজকর্মী হাজেম আল শামি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলাকে নেতিবাচকভাবে নিয়েছে সিরিয়ার বেসামরিক নাগরিকেরা। তিনি বলেন, ‘এই হামলার কোনো কার্যকারিতা নেই, কোনো সেনাঘাঁটি কিংবা যেখানে থেকে জঙ্গিবিমান উড্ডয়ন করে ব্যারেল বোমা ফেলে- তেমন কিছুই ধ্বংস হয়নি এই হামলায়।

গৃহযুদ্ধের শুরু থেকেই বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অনেকগুলো এলাকায় রাসায়নিক হামলা হয়েছে; কিন্তু একবারও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে এমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পায়নি যা বাশার সরকারকে চাপে ফেলতে পারে’। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত পূর্ব গৌতায় বাশার সরকার ও তাদের বিদেশী মিত্রদের দুই মাসের দীর্ঘ হামলার পর পশ্চিমাদের কাছ থেকে এই প্রতিক্রিয়া এলো। তত দিনে আরো অনেক বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকার মতো পূর্ব গৌতাও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

২০১৩ সাল থেকে রাজধানী দামেস্কের নিকটস্থ এই অঞ্চলটি বিদ্রোহীদের দখলে ছিল। এবারের হামলায় অন্তত এক হাজার ৬০০ বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় দেড় লাখ লোক। এই এলাকার উদ্বাস্তুদের একজন নূর আদম মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে শনিবারের এই হামলায় বাশার সরকারের ওপর কোনো প্রভাবই ফেলবে না। রাশিয়ার মধ্যস্ততায় গৌতা ছেড়ে আরো অনেকের মতো উত্তর সিরিয়ায় আশ্রয় নেয়া এই ব্যক্তি বলেন, ‘আরো অনেক দিন আগেই এমন হামলা হওয়া উচিত ছিল। আমরা আশা করেছিলাম তারা সরকার ও তাদের মিত্র ইরান-রাশিয়ার ঘাঁটি ধ্বংস করতে পারবে।’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে তিন দেশের সম্মিলিত হামলায় দামেস্কের একটি রাসায়নিক গবেষণাগার এবং হোমসের দু’টি অস্ত্রাগার ও একটি কমান্ড পোস্ট লক্ষ্য করে হামলা হয়েছে। মার্কিন হামলা কেন আরো আগে হয়নি সেটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে নূর আদম বলেন, ‘তারা সরকারের গৌতা দখল করা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে, এসব ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। রাশিয়া ও বাশার সরকার যখন গৌতা দখল করে নিয়েছে, তারপর তারা হামলা চালিয়েছে’। বর্তমানে অষ্টম বছর চলছে সিরিয়ার যুদ্ধের। ২০১৫ সালে রাশিয়া এই যুদ্ধে যোগ দেয়ার আগে বিদ্রোহীরা বেশ শক্ত অবস্থানেই ছিল। কিন্তু রাশিয়া ও ইরানের সহযোগিতায় গত দুই বছরে ক্রমে অবস্থান জোরদার করেছে বাশার সরকার। বিদ্রোহীরা এখন অনেকটাই কোণঠাসা, উত্তরাঞ্চলীয় কিছু এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ আছে শুধুমাত্র।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিদ্রোহীদের চাপে রাখতে অনেক আগে থেকেই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করছে বাশার সরকার। আলেপ্পোর সাংবাদিক ফিরাস আল আবদুল্লাহ মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের যদি সত্যিই বাশারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ইচ্ছে থাকে তবে তারা আরো অনেক আগেই তাকে থামাতে পারত। তিনি বলেন, ‘যদি সিরিয়ার সরকারের বর্বরতার বিষয়ে তারা গুরুত্ব দিত, তাহলে তারা অনেক আগেই সেটি করত। তাদের কাছে বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করা পাঁচ মিনিটের কাজ’। ফিরাস আল আবদুল্লাহ বলেন, ‘তারা চায় না এই যুদ্ধ শেষ হোক। এই হামলায় সিরিয়ার জনগণের কোনো উপকার হয়নি। (পশ্চিমা) দেশগুলো নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য হামলা চালিয়েছে’।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সিরিয়ার এবারের পশ্চিমা হামলা পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার আর্কেডিয়া ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামির আববৌদ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো রাজনৈতিক নীতিতেই এই হামলা হয়েছে। হামলার পরিমাণেও সেটি স্পষ্ট হয়েছে।’ তিনি মনে করেন এই হামলা সিরিয়ার সরকারকে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার থেকে বিরত রাখতে পারবে না, কারণ ওবামার ঠিক করে দেয়া ‘বিপদসীমা’ও তাদের বিরত রাখতে পারেনি।

সিরিয়ার বিশেষজ্ঞ ও সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশনের গবেষক অ্যারন লুন্ড মনে করেন, রাসায়নিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করতে বছরের পর বছর যে কূটনৈতিক পরিশ্রম করা হয়েছে সেটি রক্ষা করতেই যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় হামলা করেছে। কারণ বাশার সরকারের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার আবারো বিশ্বে রাসায়নিক যুদ্ধ লাগিয়ে দিতে পারে। কেউ কেউ মনে করছেন এই হামলা হয়েছে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদ ধ্বংস করতে। তবে বেশির ভাগই একমত যে, এই হামলা হয়েছে শুধুমাত্র সিরিয়ার ছায়াযুদ্ধে ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে।

তুরস্ক ভিত্তিক সিরিয়ার রাজনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ওম কৌচ বলেন, ‘প্রত্যেক সামরিক হামলার পেছনেই একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। এটি কতটা ভয়াবহ ছিল কিংবা এতে বাশার সরকারের পতন হবে কি না সেটি কোনো বিষয় নয়।’ বাশার সরকারকে জেনেভা শান্তি আলোচনায় ফিরিয়ে নেয়াও এই হামলার উদ্দেশ্য বলে মনে করেন তিনি।
আলজাজিরা যাদের সাথে কথা বলেছে, সেই বিশ্লেষকদের সবাই একমত যে, এই চাপে বাশার রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার বন্ধ করলেও তার ব্যারেল বোমা হামলা চলতেই থাকবে’।

দৈনিকদেশজনতা/ আই সি

প্রকাশ :এপ্রিল ১৭, ২০১৮ ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ