সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশী তরুণরা বেশকিছুদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছে। তারা বলছে যে, বর্তমানে যে কোটানীতি বহাল আছে, তাতে মেধাবীদের মূল্যায়ন হচ্ছে না। তাই এর সংস্কার ও পুর্নমূল্যায়ন করতে হবে। কোটা কমিয়ে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে প্রকৃত মেধাবিদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের এ দাবির যৌক্তিকতা অস্বীকার করার উপায় নেই। কেননা, বিশেষ কোটায় চাকরি দেয়া হলে অনেক ক্ষেত্রেই মেধার মূল্যায়ন হয় না। কোটার বাইরে থাকা অনেক মেধাবি চাকরিপ্রার্থী বাদ পড়ে যান। উল্টোদিকে কোটার আওতায় অপেক্ষাকৃত কম মেধাবিরা চাকরির যোগ্য হয়ে যান।
বর্তমানে দেশে যে কোটানীতি রয়েছে, তাতে মোট নিয়োগের ৫৬ শতাংশই কোটার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। মাত্র ৪৪ শতাংশ নিয়োগ দেয়া হয় মেধার ভিত্তিতে। বর্তমানে যে কোটানীতি রয়েছে,তার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী ৫ শতাংশ এবং কোনো কোটা পূরণ না হলে সে ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ কোটা নির্ধারিত রয়েছে। অন্যদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা যে পাঁচ দফা দাবি পেশ করেছে সেগুলো হলো- কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে তা মেধাবীদের মধ্য থেকে পূরণ করা, কোনো ধরণের বিশেষ পরীক্ষা না নেয়া. সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা একবারের বেশি ব্যবহার না করা।
অন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের এ দাবি সমূহকে অযৌক্তি বলার সুযোগ নেই। কেননা, দক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলতে হলে নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই মেধাবীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
তাছাড়া, আমাদের সংবিধানের ১৯(১), ২৯(১) ও ২৯(২) অনুচ্ছেদে চাকরি ক্ষেত্রে সব নাগরিকের সমান সুযোগের কথা বলা হয়েছে। আবার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনের দিকে এগিয়ে আনতে কোটা পদ্ধতিরও দরকার আছে। তবে, সময়ের প্রেক্ষিতে এর যুগোপযোগী সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। একটা সময় ছিল যখন সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদেরকে সামনের দিকে নিয়ে আসার জন্য বিশেষ কোটার প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে দেশ অনেক এগিয়েছে,শিক্ষিত মেধাবী চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যাও এখন অনেক বেড়েছে। সে সাথে দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাও তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। ফলে বিশেষ পুরনো কোটা ব্যবস্থা বহাল রেখে মেধাবী ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কোনো মানে নেই।
এদিকে, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ক্রমশ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। গত ৭ এপ্রিল থেকে আন্দোলনকারীরা ঢাকার শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচী শুরু করেছে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী তাতে অংশ নেয়। এমন কি গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও রাজপথে নেমে আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে। পুলিশ রাস্তা পরিষ্কার করার নামে আন্দেলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট ছুঁড়লে বেশ কয়েকজন আহত হয়। ওই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসায় হামলার ঘটনাও ঘটেছে। একই রাতে এবং তার পরদিন আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়েছে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরদিন আন্দোলন দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচী পালন করেছে।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে কোটা ব্যবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। গত ৮ এপ্রিল সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের একটি প্রতিনিধি দলের বৈঠক শেষে এ ঘোষণা দেয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচী স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু অপর অংশ সরকারের আশ্বাস প্রত্যাখ্যান করে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। তারা ৬ দিনের মধ্যে দাবি মানার আল্টিমেটাম দিয়েছে। ১৫ এপ্রিলের মধ্যে দাবি না মানলে ১৬ এপ্রিল ‘চল চল ঢাকা চল’ কর্মসূচী পালন করা হবে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, সরকারবিরোধী আন্দোলনও নয়। যারা এ আন্দোলন করছে, তারা রাষ্ট্রীয় একটি পদ্ধতির সংস্কারের দাবি তুলেছে। কিন্তু সে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের হামলা অত্যন্ত নিন্দনীয়। এটা পুলিশের বাড়াবাড়ি। পাশাপাশি সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের হামলা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক। এসব হামলার নিন্দা জানিয়েছে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। বিএনপি আন্দোলনকারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছে, তারা সরকারে গেলে কোটা কমিয়ে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করবে।
আমরা কোটা সংস্কারের এ আন্দোলনকে অত্যন্ত যৌক্তিক এবং সময়োপযোগী বলে মনে করি। কোনো এক সময়ে বিশেষ কারণে প্রণীত একটি নীতিকে চিরকাল বহাল রাখতে হবে এর কোনো মানে নেই। সরকার আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নিয়ে সৃষ্ট অস্বস্তিকর পরিস্থিতির অবসান ঘটাবে- দেশবাসীর প্রত্যাশা সেটাই।