নিজস্ব প্রতিবেদক:
মুক্তিযোদ্ধার অবর্তমানে সম্মানী ভাতাসহ সরকারি যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পাবেন স্ত্রী বা স্বামী। আর তাদের অবর্তমানে সুবিধা ভোগ করবেন পিতা-মাতা। তারাও না থাকলে সুবিধা পাবেন ছেলে-মেয়েরা।
এছাড়া এ বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে রয়েছে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নসংক্রান্ত ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন উপস্থাপন, কৃষি বিপণন আইন, স্ট্যান্ডার্ড ওজন ও পরিমাপ আইন, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র-বাংলাদেশ আইন এবং সরকারি ইমেইল নীতিমালার খসড়া অনুমোদনের প্রস্তাব।
এছাড়াও বেশ কয়েকটি অবহিতকরণও রয়েছে আলোচ্যসূচিতে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাসহ সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটি শিগগিরই মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের কথা রয়েছে।
এটি কার্যকর হলে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞাসহ নানা অমীমাংসিত বিষয়ের সুরাহা হবে। পাশাপাশি সামরিকসহ সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারাও সম্মানী ভাতার আওতায় আসবেন।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে প্রণীত রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের আওতায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট পরিচালিত হলেও এবারই প্রথম নতুন আইন করা হচ্ছে।
এ আইনে যুদ্ধাহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের সোয়া দুই লাখেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধা, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার অবর্তমানে পরিবারের সদস্যরাও এ সুবিধা পাবেন।
পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদেরও এই প্রথম মুক্তিযোদ্ধা ভাতার আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা এবং ট্রাস্টের কার্যক্রম পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে ট্রাস্টি বোর্ড, নির্বাহী কমিটি গঠনের পাশাপাশি তহবিল পরিচালনা, নিরীক্ষার বিধানও খসড়া আইনে রাখা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধার সুবিধাভোগী প্রসঙ্গে প্রস্তাবিত খসড়ায় বলা হয়েছে, সুবিধাভোগী অর্থ মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যরা। তাদের অবর্তমানে স্ত্রী-স্বামী, স্ত্রী ও স্বামীর অবর্তমানে পিতা-মাতা। স্ত্রী-স্বামী অথবা পিতা-মাতার অবর্তমানে পুত্র ও কন্যারা।
উল্লিখিত ব্যক্তিদের কেউই না থাকলে বা তাদের অবর্তমানে ভাই-বোন মুক্তিযোদ্ধার সুবিধাভোগী হবেন।
প্রথমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে খসড়ায় বলা হয়েছে- ‘একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে সব ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তারা ছাড়াও নিচের (ক থেকে ঝ) উল্লিখিত ব্যক্তিগণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন। (ক) মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ব্যক্তি বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন, (খ) যে সব বাংলাদেশি পেশাজীবী ও নাগরিক একই সময়ে বিদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠন করেছেন, (গ) যারা মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা/কর্মচারী/দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, (ঘ) সশস্ত্র বাহিনী, গণবাহিনী ও অন্যান্য স্বীকৃত বাহিনী, পুলিশ, ইপিআর, নৌকমান্ডো, আনসার বাহিনীর সদস্য যারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, (ঙ) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুজিবনগর সরকারের সহিত সম্পৃক্ত তৎকালীন এমএনএ (মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি) ও এমপিএগণ (মেম্বার অব পার্লামেন্টারি অ্যাসেম্বলি) যারা পরে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হন, (চ) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসরদের সহযোগী কর্তৃক নির্যাতিত (বীরাঙ্গনা) নারীগণ, (ছ) স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়গণ এবং (ঝ) মুক্তিযুদ্ধের সময় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী মেডিকেল টিমের চিকিৎসক, নার্স ও সহকারীরা। তবে শর্ত থাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধকালীন বয়স ন্যূনতম সাড়ে ১২ বছর (সংশোধিত বিধান অনুসারে) হতে হবে।
৬৩ সিদ্ধান্তের ৪৩টিই বাস্তবায়ন : আজকের বৈঠকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও অগ্রগতির ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করতে আলোচ্যসূচিতে রাখা হয়েছে। প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, এই তিন মাসে মন্ত্রিসভার ৭টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে মোট ৬৩টি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, যার ৪৩টিই বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকি ২০টি বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এছাড়া ৩টি নীতি ও কর্মকৌশল এবং ৪টি এমওইউ সই অনুমোদন করা হয়েছে। আর এ সময়ে সংসদে ১৫টি আইন পাস হয়েছে।
কৃষি বিপণন আইন : মজুদদারি বন্ধে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের রসিদ সংরক্ষণের বিধান রেখে কৃষি বিপণন আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এ আইনে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে ‘কৃষিপণ্য কেনাবেচার সময় পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা মূল রসিদ সংরক্ষণ করবেন।
কৃষি বিপণন অধিদফতরের কর্মকর্তারা বিক্রেতাদের এসব রসিদ নিয়মিত পরীক্ষা করবেন। বিক্রেতাদের সংঘটিত অপরাধ ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে বিচার করা হবে।’ কৃষিপণ্য বা প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের গুণাগুণ রক্ষার বিষয়টিও নতুন আইনে গুরুত্ব পেয়েছে। প্রক্রিয়াজাতকরণ কৃষিপণ্যের মোড়কে পণ্যের পুষ্টিমান ও উপাদানের শতকরা হার, উৎপাদনের তারিখ ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এবং বিক্রয়মূল্য উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এছাড়া রাসায়নিক উপাদান ব্যবহারের ক্ষেত্রেও শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। অপরিপক্ব বা অপরিণত ফল পাকানো যাবে না। দুধ, মাছ, মাংস, ফল শাক-সবজিসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য বা অন্য কোনো উদ্দেশে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা যাবে না। এ ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান প্রয়োগ করা হবে।
সরকারি কাজে ব্যক্তিগত মেইল নয় : সরকারি কাজে ইলেকট্রনিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইচ্ছামতো জিমেইল, ইয়াহু, আউটলুকসহ অন্যান্য ইমেইল ব্যবহার করা যাবে না। সরকারি কার্যক্রমের গোপনীয়তা রক্ষা, অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ও সাইবার নিরাপত্তার জন্য ইমেইল ব্যবহারে ‘সরকারি ইমেইল নীতিমালা-২০১৮’ নামে একটি নীতিমালা করা হচ্ছে। একটি অভিন্ন ডোমেইন ‘ডট বিডি’র ঠিকানা যুক্ত ইমেইল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ইমেইল ব্যবহারকে সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে আনতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নীতিমালাটি অনুমোদন পেলে সরকারি কোনো কাজে আর ব্যক্তিগত ইমেইল ব্যবহার করা যাবে না। তখন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রত্যেকেই মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর ও সংস্থার নামসহ ‘ডট বিডি’ ডোমেইনে একটি ইমেইল আইডি তৈরি করে সেটা দিয়ে সরকারি কাজে মেইল আদান-প্রদান করতে হবে।
এ ইমেইল আইডি তারা শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যবহার করতে পারবেন। ব্যক্তিগত বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহার করা যাবে না। অপরদিকে অভিন্ন ডোমেইনে এই ইমেইল সেবা দেবে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)। তারা ইমেইল সার্ভিস প্রোভাইডার (ইএসপি) হিসেবে কাজ করবে।
জানা গেছে, সরকারি কাজে গোপনীয়তা রক্ষা ও অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং সাইবার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে একটি নির্দেশনা দেন। ওই নির্দেশনা অনুসরণ করে প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ইলেকট্রনিক যোগাযোগের জন্য ইমেইল ব্যবহারকারীদের একই নিয়মের অধীনে আনতে ইমেইল নীতিমালা করা হয়েছে।
তবে এ নীতিমালা জাতীয় নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত সংস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনসহ স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তারা ইলেকট্রনিক যোগাযোগের জন্য তাদের কর্তৃপক্ষের নিয়মে ইমেইল ব্যবহার করবে।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ