২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৩:৪৩

প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি হামহাম জলপ্রপাত

নিজস্ব প্রতিবেদক :

মানব মন সর্বদা মুক্তি পিয়াসী, চিরচঞ্চল। একটু অবকাশ পেলেই মানুষ ছুটে যায় দিগ দিগন্তে সৌন্দর্যের আকর্ষেণে। জন্মগত ভাবেই মানুষ কৌতূহলী। তার সে কৌতূহল নতুন নতুন বিষয়ের প্রতি। প্রকৃতি ও মানুষের সৃষ্ট সৌন্দর্যের নানা নিদর্শন সে মানবীয় সত্তা দিয়ে অনুভব ও উপলব্ধি করতে চায়। তাহলে পরিচয় করিয়ে দেই এক আকর্ষণীয় পর্যটন নগরীর সাথে। যেখানে দীর্ঘ পথ জুড়ে সবুজ গালিচা বিছিয়ে আছে সারি সারি চা-বাগান ৷ চা কন্যারা নিপুণ হাতে দু’টি পাতা আর একটি কুঁড়ি সংগ্রহ করে ঝুলিতে ভরছেন ৷ এরই মাঝে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ছায়াবৃক্ষ । তাতে হয়তো শিষ দিচ্ছে নানা রূপরঙের সুরেলা পাখি । পিচঢালা পথে চলতে চলতে স্বর্গীয় এক অনুভূতি ছুঁয়ে যায়৷ এমনই এক অপার মায়াবী সৌন্দর্যের লীলাভূমির নাম হামহাম জলপ্রপাত৷

অরণ্যঘেরা মায়াবী হামহাম জলপ্রপাত এর কাঁচের মতো স্বচ্ছ পানি পাহাড়ের শরীর বেয়ে আছড়ে পড়ছে বড় বড় পাথরের গায়ে, গুড়ি গুড়ি জলকণা আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশার আভা। বুনোপাহাড়ের প্রায় ১৬০ ফুট উপর থেকে গড়িয়ে পড়া স্রোতধারা কলকল শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে পাথরের পর পাথর কেটে, সামনের দিকে তার গন্তব্যে। চারিপাশ গাছ গাছালি আর নাম না জানা হাজারো প্রজাতির লাতপাতা ও লতাগুল্মে আচ্ছাদিত হয়ে আছে পাহাড়ী শরীর। স্রোতধারা সে লতাগুল্ম কে ভেদ করে গড়িয়ে পড়ছে ভূমিতে। তৈরি করছে জলধারা। সে যে কি এক বুনোপরিবেশ না দেখলে বিশ্বাস করানো সম্ভব নয়। শ্রাবনের প্রবল বর্ষণে যখন পুরো জঙ্গল ফিরে পায় তার চিরসবুজ, হয়ে উঠে সতেজ আর নবেযৌবনা। হামহাম ঝর্না তখন ফিরে পায় অপরুপ সৌন্দর্য। ঝর্নার সতেজতায় পাহাড়ি ঝিরিগুলো হয়ে উঠে কর্মচঞ্চল। সাঁই সাঁই করে ধেয়ে চলে ঝিরির জলরাশি। স্বচ্ছ জলস্রোত যখন পা গলিয়ে চলে যায় নদীর দিকে সে জলের কোমল পরশে শরীর জুড়িয়ে যায় মূহুর্তেই।

হামহাম জলপ্রপাত সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বনবিটের গহীন অরণ্যে অবস্থিত। কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০কিঃমিঃ পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত রাজকান্দি পাহাড়ের কুরমা বনবিট এলাকার আয়তন ৭ হাজার ৯৭০ একর। কুরমা বনবিট এলাকার পশ্চিমদিকে চাম্পারায় চা বাগান, পূর্ব-দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত। এই বনবিটের প্রায় ৮.৫ কি.মি. অভ্যন্তরে দৃষ্টিনন্দন এই হামহাম জলপ্রপাতটির অবস্থান। কমলগঞ্জ থেকে কুরমা চেকপোষ্ট পর্যন্ত প্রায় ২৫ কি. পাকা রাস্তা। কুরমা চেকপোস্ট থেকে চাম্পারায় চা বাগান পর্যন্ত ১৫ কি.মি. মাটির রাস্তা। সেখান থেকে আবার প্রায় ৫ কিমি. দূরে সীমান্ত এলাকায় আদিবাসীদের বসতি কলাবনপাড়া। সেখান থেকেই শুরু দুর্গম জঙ্গল। সেই জঙ্গলের প্রায় ৮.৫ কি.মি. ভিতরে অবস্থিত হামহাম জলপ্রপাত।

শুধুমাত্র উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রচার প্রচারণার অভাবে বাংলাদেশের অন্যতম এই জলপ্রপাতটি আজও রয়ে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। কেবলমাত্র দৃষ্টিনন্দন ঝর্না নয়, পথের দুপাশের বুনো গাছের সজ্জা দৃষ্টি কেড়ে নেয় অনায়েসে। জারুল, চিকরাশি ও কদম গাছের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন ডানা মেলে দেয় হাজারো প্রজাপতি। চশমা বানরের আনাগোনা ডুমুর গাছের শাখায় । চারদিকে গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর এ বনাঞ্চল। ডলু, মুলি, মিটিংগা, কালি ইত্যাদি অদ্ভুত নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ এ বাগানগুলোকে দিয়েছে ভিন্ন একরূপ। পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি পথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর পাখির কলরব মনকে ভাললাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেবে। দূর থেকে কানে ভেসে আসে বিপন্ন প্রায় বনমানুষের ডাক। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর শুরুতে দু’চোখের সামনে ভেসে উঠে পাহাড় থেকে ধোঁয়ার মতো ঘন কুয়াশা ভেসে উঠার অপূর্ব দৃশ্য। মনে হয় যেন ওই নয়নাভিরাম পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে যাবে কাঙ্খিত হামহাম জলপ্রপাতের কাছাকাছি। কিছু দূর এগুলেই শুনতে পাবে হামহাম জলপ্রপাতের শব্দ। কাছে গিয়ে দেখতে পাবে প্রায় ১৫০ ফিট ওপর হতে আসা জলপ্রপাতের সেই অপূর্ব দৃশ্য । প্রবল ধারায় উপর হতে গড়িয়ে পরছে ঝর্ণার পানি নিচে থাকা পাথরের উপর। পাথরের আঘাতে জলকণা বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশা। চারিদিকে এক শীতল শান্ত পরিবেশ। ডানে বামে চোখ ফেরানোর উপায় নেই। কেবলই ইচ্ছে করবে তাকিয়ে থাকি সৃষ্টিকর্তার এই অনন্য সৃষ্টির জন্য। জঙ্গলে উল্লুক, বানর আর হাজার পাখির ডাকাডাকির সাথে ঝর্নার ঝরে পড়ার শব্দ মিলে মিশে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ। ক্ষণিকের জন্য ভুলেই যেতে হবে কোথায় আছে, কিভাবে আছেন! উপরে আকাশ, চারিদিকে বন, পায়ের নিচে ঝিরির স্বচ্ছ জল আর সম্মুখে অপরূপ ঝর্না। নিজেকে না হারিয়ে আর কি কোন উপায় আছে?

প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর বর্ণনা যতটা সুন্দর ও লোভনীয় যাত্রাপথ কিন্তু ততটা নয়। উচু নিচু পাহাড়া আর টিলা, বুনো জঙ্গল, পাথুরে আর কদর্মাক্ত পথ, কোথাও হাঁটু সমান আবার কোথাও কোমর সমান ঝিরিপানি। শুধু তাই নয় এই দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে প্রবল শত্রু হিসেবে পেয়ে যাবে অসংখ্য বন্য মশা মাছি এবং রক্তচোষা জোঁক। এই পথ পাড়ি দিয়েছে অথচ কেউ জোকের কবলে পড়েনি এমনটি ভাবা স্বপ্নবিলাশ। পাহাড়ি পথ মারাতে গিয়ে আপনাকে ঘাম ঝরাতে হবে, পরিশ্রান্ত হতে হবে, কখনো পিছু হটতে মন চাইবে। খাদ্য আর পানীয়র অভাব তোমাকে কখনো অসহায় করে তুলতে পারে। তারপরও সৌন্দর্য পিপাষুদের অদম্য ইচ্ছার কাছে এইসবের কোন কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা।

উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কি.মি. পূর্ব-দক্ষিণে রাজকান্দি বন রেঞ্জের কুরমা বনবিট এলাকার প্রায় ১০ কি.মি. গহীন অরণ্যেও এই দুর্গম দৃষ্টিনন্দন হামহাম জলপ্রপাতে সরাসরি যানবাহন নিয়ে পৌঁছার ব্যবস্থা নেই। উপজেলা সদর থেকে কুরমা চেকপোস্ট পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিঃমিঃ পাকা রাস্তায় স্থানীয় বাস, জিপ, সিএনজি ও মাইক্রোবাসে যেতে হয়। বাকি ১০ কি.মি. যেতে হয় পায়ে হেঁটে। সেখান থেকে প্রায় ৫ কি.মি. দূরে সীমান্ত এলাকায় ত্রিপুরা আদিবাসী পল্লী। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা তৈলংবাড়ী কলাবন বস্তি থেকে পায়ে হেঁটে রওয়ানা হতে হবে। প্রায় ৬ কি.মি. পাহাড় টিলা ও ২ কি.মি. ছড়ার পানি অতিক্রম করে ৩ ঘণ্টা পায়ে হাঁটার পর দেখতে পাওয়া যায় ১৬০ ফুট উচ্চতার এই ঝর্ণা সুন্দরী হামহাম জলপ্রপাতের আঙিনা।

হামহাম যাবার জন্য সাথে একজন গাইড নিয়ে যাওয়া অত্যাবশ্যক। কারণ প্রথমবার যারা যাবে তাদের জন্য রাস্তা ভুল করাই স্বাভাবিক। কলাবন গেলে গাইড পাওয়া যায়। একজনকে সাথে নিয়ে যেতে পারো। গাইডদেরকে প্রতিজনে ১৫০-২০০ টাকা দিলেই হবে। ট্র্যাকিং করার সময় সবার হাতে একটি করে বাঁশ বা লাঠি নিয়ে যাবে। এটি ভারসাম্য রক্ষা করতে, হাঁটতে এবং সাপ বা অন্যান্য বন্যপ্রাণী হতে নিরাপদ রাখবে। দুপুরে খাবার জন্য হালকা শুকনা খাবার নিয়ে যাওয়া ভালো। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ডেটল, নাপা, তুলা এগুলো নিয়ে নিতে পারো। বর্ষাকালে ঝর্ণার প্রকৃতরূপ টা দেখা যায়। তবে সেক্ষেত্রে যাবার রাস্তায় কষ্টও বেশী হবে। শীতকালে রাস্তায় তেমন পানি থাকেন া বলে যাওয়াটা একটু সহজ। কিন্তু শীতে অধিকাংশ ঝর্ণাতেই একদম পানি থাকে না। সেটা দেখাও খুব একটা সুখকর নয়। সুতরাং কষ্ট হলেও বর্ষাকালেই যাওয়া উচিত।

হামহাম জলপ্রপাতে পৌঁছার পর অপরূপ নির্মল ওই সৌন্দর্যে নিমেষে জুড়িয়ে যায় পথের ক্লান্তি। পথের দু’ পাশের বুনো গাছের সজ্জা যে কোনো পর্যটকের দৃষ্টি ফেরাতে সক্ষম। জারুল, চিকরাশি ও কদম গাছের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন ডানা মেলে দেয় হাজারো প্রজাপতি। চশমা বানরের আনাগোনা ডুমুর গাছের শাখায়। চারদিকে গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর এ বনাঞ্চল। ডলু, মুলি, মিটিংগা, কালি ইত্যাদি অদ্ভুত নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ এ বাগানগুলোকে দিয়েছে ভিন্ন এক রূপ। পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি পথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর পাখির কলরব মনকে ভাললাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেয়।

দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :এপ্রিল ৪, ২০১৮ ১২:৫১ অপরাহ্ণ