নিজস্ব প্রতিবেদক:
অস্বাভাবিকভাবে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় রড ও সিমেন্টের দাম বেড়েই চলছে। কারণ এর কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। রাজধানীতে এখন প্রতি টন রড বিক্রি হচ্ছে ৭১ হাজার ৫০০ টাকায়। ঢাকার বাইরে আরও বেশি। অথচ ৮ মাস আগে প্রতি টন রড ৫২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ ৮ মাসে বেড়েছে ১৯ হাজার টাকা। অন্যদিকে ৬ মাসে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) সিমেন্টের দাম বেড়েছে ১০০ টাকা। এর ফলে আবাসন ও নির্মাণ খাতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া শুধু রড-সিমেন্ট নয়, ডলারের দাম ৪ টাকা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি আমদানি পণ্যে সরাসরি এর প্রভাব পড়ছে। গুনতে হচ্ছে বাড়তি শুল্কহার। সাধারণ মানুষসহ যার প্রভাব পড়ছে সর্বত্র।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মানোয়ার হোসেন বলেন, কোনো সিন্ডিকেট নয়, রডের মূল কাঁচামাল স্ক্র্যাপ লোহা আমদানির খরচ টনপ্রতি ৩০০ ডলার থেকে বেড়ে ৪৩৫ ডলার হয়েছে। এর একটা প্রধান কারণ চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে দেরি হওয়ায় জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে কাঁচামাল কারখানায় আনা এবং তৈরি পণ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে টনপ্রতি আট হাজার টাকা পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। যার কারণে রডের দাম বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে একজন আমদানিকারক বলেন, শুধু রডের কাঁচামাল কেন যে কোনো পণ্য আমদানিতে খরচ অনেক বেড়ে গেছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ৭৯-৮০ টাকার ডলার এখন হয়ে গেছে ৮৪ টাকা। এছাড়া ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি শুল্কও বেড়ে যাচ্ছে। প্রতি ডলারে অতিরিক্ত ২ টাকা করে শুল্ক গুনতে হচ্ছে। ফলে ডলার প্রতি আমদানি খরচ বেড়েছে কমপক্ষে ৬ টাকা। তিনি মনে করেন, ডলারের দাম বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব না হলে আমদানি পণ্যে ব্যয় বাড়তেই থাকবে। এতে করে উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকবে। যার প্রভাব পড়বে সব ক্ষেত্রে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন রড-সিমেন্ট বিক্রির ভরা মৌসুম। তাই যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই দাম বাড়াচ্ছেন মিল মালিকরা। তারা সিন্ডিকেট করে অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর সাধারণ ক্রেতাদের মতে, শুষ্ক মৌসুমে এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের পরিকল্পিত কারসাজি। তবে ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঁচামালের মূল্য ও পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে দেরি হচ্ছে। ব্যাংক ঋণে সুদের হার বেড়েছে। এসবের কারণেই রড ও সিমেন্টের দাম বাড়ছে।
জানতে চাইলে ক্যাবের সভাপতি ড. গোলাম রহমান বলেন, বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে রডের দাম বাড়ানো হচ্ছে। ফলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া বেসরকারিভাবে যারা অবকাঠামো নির্মাণ করছে তাদের ওপর চাপ বাড়তে শুরু করেছে। যারা বাড়িঘর তৈরি করছে তাদেরও ব্যয় বাড়ছে। আর ভাড়াটিয়াদের এর ভার বহন করতে হবে। তাই সরকারের উচিত দাম বৃদ্ধির বিষয়টি এখনই খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া। যাতে করে রড ও সিমেন্টের দামে লাগাম টানা যায়।
রাজধানীর পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে ইংলিশ রোড ঘুরে রড ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতি টন ৫০০ টিএমটি বার বিক্রি হয় ৬৮ হাজার ৫০০ থেকে ৭১ হাজার ৫০০ টাকায়। গত বছরের আগস্টে এর দাম ছিল ৪৯ হাজার থেকে ৫২ হাজার টাকা। সে ক্ষেত্রে এ ৮ মাসে রডের দাম বেড়েছে ১৯ হাজার টাকা। এর মধ্যে মাসখানেকের মধ্যে এসব রডের দাম টনপ্রতি ১০-১১ হাজার টাকা বেড়েছে। একই স্থানে ৪০ গ্রেডের রড প্রতি টন ৬০ হাজার থেকে ৬২ হাজার টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। যা ৮ মাস আগে ৪৪ হাজার টাকা ছিল।
দাম বাড়ার বিষয়ে একই স্থানের স্কাই আয়রন স্টোরের মালিক এসএম সাগীর (রকি) বলেন, গত বছর থেকে রডের দাম বেড়েই চলেছে। ৮ মাসের ব্যবধানে ১৮ থেকে ১৯ হাজার টাকা বেড়েছে। তিনি বলেন, মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। সিমেন্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৬ মাসে বিভিন্ন কোম্পানির সিমেন্টের বস্তা (৫০ কেজি) দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। ৬ মাস আগে বিভিন্ন কোম্পানির সিমেন্ট প্রতি বস্তা বিক্রি হতো ৩৬০ থেকে ৩৯০ টাকা। বর্তমান বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৪৬০ থেকে ৪৭০ টাকা।
কারওয়ান বাজারের খুচরা সিমেন্ট ব্যবসায়ী মেসার্স আলভি ট্রেডার্সের মালিক ফারুক বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতি বস্তা সিমেন্টে ৬০ থেকে ৮০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। বস্তাপ্রতি প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ টাকা বাড়ছে। তিনি বলেন, আমরা যা দাম দিয়ে নিয়ে আসি তা থেকে পাঁচ থেকে আট টাকা বেশি দিয়ে বিক্রি করি। দাম বাড়ানোর পেছনে আমাদের কোনো হাত নেই। এ বিষয়ে এমআই সিমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ খান বলেন, কিছু দিন আগেও প্রতি টন ক্লিংকারের দাম ছিল ৪০ ডলার, তা এখন ৪৮-৫০ ডলার। একইভাবে জিপসামসহ অন্যান্য কাঁচামালের দরও বাড়তি। জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়া কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির বড় কারণ। পরিবহন খরচের বিষয়ে মাসুদ খান বলেন, চট্টগ্রাম থেকে একটি ট্রাকে আগে ৪০০ ব্যাগ সিমেন্ট আনা যেত, এখন সেখানে ২৪০ ব্যাগের বেশি আনতে দিচ্ছে না সরকার। এতে খরচ বেড়েছে। যার কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে।
রড ও সিমেন্টের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে আবাসন খাতের কোম্পানিগুলো। তারা বলছে, এতে নির্মাণ ব্যয় বাড়ছে। ফলে ফ্ল্যাটের দামের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। রিহ্যাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার তানভির হক প্রবাল বলেন, রডের দাম বেড়ে গেলে আবাসন খাতে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে। রড ও সিমেন্টর দাম বাড়লে অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় বেড়ে যায়। এ ছাড়া একজন ব্যবসায়ী হিসেবে দাম বাড়ায় অনেক ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। ক্রেতাদের কাছে বেশি দাম চাওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে খুব বিপদের মধ্যে আছি। তাই দাম কমানোর জন্য অবশ্যই রিহ্যাবকেই আন্দোলন করতে হবে।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি