২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সন্ধ্যা ৬:৪০

রেলওয়ের নাম ‘দুঃখ প্রকাশ’

নিজস্ব প্রতিবেদক:

কমলাপুর রেলস্টেশনে এমন অবস্থার সম্মুখীন হবেন সেটা ভাবতেই পারেননি শাহজাহান মৃধা (৪৮)। জরুরি কাজে যাবেন রংপুর। সড়কপথে না গিয়ে নিরাপদ ভ্রমণের জন্য ট্রেনকেই বেছে নিয়েছেন। তাই রংপুর এক্সপ্রেসের টিকিট কেটেছিলেন একদিন আগেই। চাকরির কাজে তিনি প্রথম রংপুর যাচ্ছেন ট্রেনে। কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা হবে সেটা ধারণারও অতীত।

সকাল সাড়ে ৮টা থেকে তিনি বসে আছেন ওয়েটিং রুমে। রংপুর এক্সপ্রেস ছাড়ার কথা ৯টায়। কিন্তু কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই স্টেশন কর্তৃপক্ষ শিডিউল পিছিয়ে দিয়েছেন। স্ক্রিনে দেখাচ্ছে রংপুর এক্সপ্রেস ছাড়বে বেলা ১১টায়। অগত্যা তিনি অপেক্ষাই করছিলেন। টানা প্রায় তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর যখন ঘড়ির কাঁটায় ১১টা বেজে ২০ মিনিট তখনো ট্রেনের কোনো খবর নেই। এ ধরণের অপেক্ষা মানুষকে কতটা ভোগান্তিতে ফেলতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সহ্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর তিনি যখন কাউন্টারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে গেলেন সেখান থেকে কোনো সদুত্তর পেলেন না। তিনি স্টেশন মাস্টারের রুম খুঁজতে লাগলেন। ততক্ষণে তার মতোই আরও অনেক যাত্রী ভিড় করেছেন স্টেশন মাস্টারের রুমে। স্টেশন মাস্টার নেই। কোথায় গেছে কেউ জানেন না। ভুক্তভোগী যাত্রীরা হৈচৈ লাগিয়ে দিয়েছেন ততক্ষণে। ভিড়ের আশপাশেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেন মৃধা। মাইকে তখন অ্যানাউন্স হচ্ছে- ‘যাত্রা বিলম্বের জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি।’  এ চিত্র গতকাল শুক্রবার কমলাপুর রেলস্টেশনের।

শুধু রংপুর এক্সপ্রেসই নয়, সৈয়দপুরগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস, ময়মনসিংহগামী ইশা-খাঁ এবং সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের ক্ষেত্রে ঘটেছে এ শিডিউল বিপর্যয়। মৌলভীবাজারের সাতগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী ‘উপবন’ এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনায় ট্রেনে এ শিডিউল বিপর্যয় হয়েছে বলে স্টেশন কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও যাত্রীদের অভিযোগ- সমস্যা হলে সিলেট রুটে হবে। দেশের অন্য রুটের ট্রেন কেন শিডিউল বিপর্যয়ে পড়বে?

রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাসুমা বেগম ইশা খাঁ এক্সপ্রেসের জন্য অপেক্ষা করছেন আধা ঘণ্টা ধরে। ময়মনসিংহগামী এ ট্রেন ছাড়ার কথা বেলা ১১টায়। শিডিউল স্ক্রিনেও সেটা প্রদর্শিত হচ্ছিল। কিন্তু স্ক্রিনের পাশেই দেয়াল ঘড়িতে সময় তখন ১১টা প্রায় বাজি বাজি করছে। ট্রেন তখনো আসেনি। এমনকি কোন প্লাটফর্মে ওই ট্রেন এসে থামবে সে তথ্যও উল্লেখ নেই কোথাও। তিনি বললেন, ‘এই রুটের ট্রেন প্রায় সময় আধাঘণ্টা, একঘণ্টা দেরি করে। এ ব্যাপারে অনেকবার অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কারণ আমরা রেল কর্তৃপক্ষের কাছে জিম্মি হয়ে আছি। তারা যখন ইচ্ছে তখন শিডিউল দিয়ে রাখে। তিনি বলেন, বাসের চেয়ে নিরাপদ বলেই ট্রেনে যাতায়াত করি। এ সুযোগটা রেল কর্তৃপক্ষ নেয় এবং আমাদের ভোগায়।’

সকাল ৯টা ৫০ মিনিটেও প্ল্যাটফর্মে আসেনি নীলসাগর এক্সপ্রেস। অথচ এ ট্রেন ছাড়ার কথা সকাল ৮টায়। স্টেশন কর্তৃপক্ষ যথারীতি কোনো ঘোষণা ছাড়াই শিডিউল পরিবর্তন করে সম্ভাব্য যাত্রার সময় লিখে রেখেছে ১০টা ৫ মিনিট। নিজেদের ইচ্ছেমাফিক দেওয়া শিডিউলও যখন তারা রক্ষা করতে পারছিল না, তখন যাত্রীক্ষোভ আর সীমার মধ্যে থাকছিল না। পুরো স্টেশনজুড়ে তখন শোরগোল। আর মাইকে এনাউন্স হচ্ছে ‘আমরা দুঃখিত’।

আরশ আলী নামের প্রায় ৮০ বছরের বয়োবৃদ্ধ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, যিনি বগুড়া যাওয়ার জন্য এসেছেন। তিনি বললেন, ‘এ দুঃখ আর নতুন কী? যতবারই যাই ততবারই রেল কর্তৃপক্ষের কোনো না কোনো কারণে ‘দুঃখিত’ শব্দটি শুনি। দুঃখ থেকে রেল আর বের হতে পারল না।’

রাত সাড়ে ১২টার দিকে মৌলভীবাজারে রেল লাইনচ্যুত হওয়ার কারণে সিলেট রুটে বৃহস্পতিবার রাত থেকে কোনো ট্রেন চলাচল করতে পারেনি। ঢাকা থেকে সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ছাড়ার কথা ছিল বেলা ১১টায়। পৌনে ১১টায়ও স্টেশন নিশ্চিত করতে পারেনি জয়ন্তিকা ছাড়বে কি না। পরে জয়ন্তিকার যাত্রা বাতিল করে যাত্রীদের টিকেটের মূল্য ফেরত দিতে হয়েছে রেল কর্তৃপক্ষকে। এরপর যথারীতি মাইকে অ্যানাউন্স করে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে শত শত মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট হওয়া, মানসিক চাপসহ নানা ভোগান্তির বিষয়টিকে কোনোভাবেই যেন আমলে নিচ্ছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে।

সরেজমিন বিভিন্ন যাত্রী ও সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো কারণে দুঃখ প্রকাশের ঘটনা এই স্টেশনে প্রতিদিনের দৃশ্য। কারণ প্রায় সময় ট্রেন শিডিউল এদিক ওদিক হয়। কমলাপুর স্টেশনের শিডিউল স্ক্রিনে সেগুলোর বেশির ভাগেরই উল্লেখ থাকে না। ফলে নির্ধারিত সময়ের আগে যাত্রীরা স্টেশনে উপস্থিত থাকলে শিডিউল দেখতে না পাওয়ায় নির্ধারিত ট্রেন অনেকে ধরতে পারেন না। আবার অনেক সময় ট্রেন প্লাটফর্মে এসে বসে থাকে কিন্তু কোনো অ্যানাউন্সমেন্ট হয় না এমনকি স্ক্রিনেও উল্লেখ করা হয় না। এ ধরনের ভোগান্তি কমলাপুর রেলস্টেশনের নিত্যদিনকার দৃশ্য। অনেকের অভিযোগ মাইকের ঘোষণাও স্পষ্ট না হওয়ায় ঠিক মতো বোঝা যায় না, তারা কী ঘোষণা দিচ্ছেন।

দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ

প্রকাশ :ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৮ ১২:৪৮ অপরাহ্ণ