২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সন্ধ্যা ৭:৪৩

হাতে উঠেছে আবার হাতপাখা

নিজস্ব প্রতিবেদক:
‘তোমার হাত পাখার বাতাসে, প্রাণ জুড়িয়ে আসে…..।’ গানটি প্রায় সবারই পরিচিত। রিকশাচালক আকবর এ গানটি গেয়ে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।  তালপাতার তৈরি হাতপাখার প্রচলন আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। গরমের দিনে হাত পাখা ছিল এদেশের মানুষের একান্ত সঙ্গী। বৈদ্যুতিক পাখার আবির্ভাবে হাতপাখার কদর অনেকাংশে কমে গিয়েছিল। কেউ কেউ গরমের দিনের এ সাথীর কথা একরকম  ভুলে যেতে বসেছিলেন। কিন্তু গত কয়েকদিনের প্রচ- গরম এবং তার সাথে পাল্লা দিয়ে লোডশেডিং-এর মাত্রা বৃদ্ধি সবাইকে আবার তালপাতার হাতপাখাকে স্মরণ করতে বাধ্য করেছে। আবার হাতে উঠে এসেছে সেই চিরচেনা হাতপাখা।
এমনি একটি খবর এসেছ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা ঝিনাইদহ থেকে। সেখানে   গরম বাড়ার সাথে সাথে ব্যস্ততা বেড়েছে  হাতপাখা কারিগরদেরও। প্রচন্ড গরমে পাখার কদর এখন সবখানে। আর তাই এ পাখা তৈরির কারিগরদের এখন যেন নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। এই গরমে মানুষকে একটু শান্তির পরশ দিতে দিন-রাত পরিশ্রম করে পাখা তৈরি করছেন ঝিনাইদহের তালপাখা কারিগররা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, পূর্ব পুরুষের ব্যবসা ধরে রেখে এখনো সংসার চালাচ্ছে পাখা কারিগররা। ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ, শৈলকুপা ও কোটচাদপুরের প্রায় ২০০টি পরিবার। এর মধ্যে জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ১০০ পরিবার পাখা তৈরি সঙ্গে জড়িত। গরম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাজ বেড়ে গেছে। একটি পাখা তৈরি করতে ১৮টি হাতের ছোয়া লাগে বলে কারিগররা জানান।
বাড়ির অন্য কাজের পাশাপাশি অনেকে এ কাজটি করছে। কিন্তু তাদের পুঁজি কম। কাচামালের দাম যখন কম থাকে তখন তারা কিনে স্টক করতে পারেন না। তাই তারা সহজ শর্তে ব্যাংক লোনের দাবি জানিয়েছেন।
জেলার দুলালমুন্দিয়া, রায়গ্রাম, কোলা ইউনিয়নের পারিয়াট, চাচড়া, আড়পাড়া এলাকা ঘুরে পাখা কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গরম পড়লেই পাখা পল্লীর কারিগরদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। কেউ পাতা কেটে সাইজ করছে, কেউ সেলাই করছে আবার কেউ বা পাখা তৈরি করেছে কেউ আবার প্রস্তুত হওয়া পাখাগুলো বিক্রির জন্য বোঝা বাঁধছে।
পাখা কারিগর বাচ্চু মিয়া জানান, তাদের পূর্ব পুরুষেরা এই তালপাখা তৈরি করে জীবন জীবিকা চালাতো। তারাও পূর্ব পুরুষের কাজটি ধরে রেখেছেন। কালীগঞ্জে প্রায় ১০০টি পরিবার পাখা তৈরির কাজ করে বলে জানান তিনি।
রায়গ্রামের সবচেয়ে পুরাতন পাখা করিগর ফজলুর রহমান ওরফে ফজু কারিগর জানান, পাখা তৈরির প্রধান উপকরণ তালপাতা সংগ্রহ করা হয় শীতকালে। গ্রীষ্মকালেও কিছু তালপাতা সংগ্রহ করা হয়। মাগুরা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা পাতা সংগ্রহ করেন। এই তালপাতা এনে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর পাতা ভিজে নরম হয়ে গেলে পানি থেকে উঠিয়ে তা কেটে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
একটা পাতায় দুটো পাখা হয়। এই পাতা পুনরায় বেঁধে রাখা হয়। এভাবে রাখার পর গরমের মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো আবার পানিতে ভিজতে দেয়া হয়। পানিতে দেবার পর পাতা নরম হয়ে গেলে শুরু হয় মূল পাখা তৈরির কাজ। সাধারণত পরিবারের বড়রা পানিতে ভিজে নরম হয়ে যাওয়া পাতা ছাড়িয়ে পাখা আকৃতির করে চারিদিক কেটে সমান করে থাকে।
আর বাড়ির মেয়েরা সেগুলো বাশের সলা দিয়ে বেঁধে ফেলে। পরিবারের ছোট সদস্যরা এগুলো সুচ আর সুতা দিয়ে সেলাই করে থাকে। এভাবে ব্যবহারের উপযোগী একটি তালপাখা তৈরি হয়।
তিনি জানান, একটি পাখা তৈরি করতে ১৮টি হাতের স্পর্শ লাগে। ফরিদপুর এলাকা থেকে ১টি তালপাতা ১০/১৫ টাকা দরে ক্রয় করা হয়। একটি তালপাতা থেকে ২টি পাখা তৈরি করা হয়। সব মিলিয়ে একটি পাখা তৈরি করতে তাদের ১৫/১৬ টাকা খরচ হয়।
পাখা কারিগর নজরুল ইসলাম জানান, তাদের তৈরিকৃত পাখা পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করা হয়। এখান থেকে পাইকাররা প্রতিপিস পাখা ১৫/১৮ টাকা দরে ক্রয় করে নিয়ে খুচরা ২০/২৫ টাকায় বিক্রি করে। মূলত পাখা ব্যবসা থাকে গরমের ৩/৪ মাস। অন্য সময় তারা কৃষি কাজ করে থাকে।
আকবর হোসেন আরো জানান, পাখা শিল্প তাদের পূর্বপুরুষের কাজ। তাই তারা এ কাজ এখনও অন্য কাজের পাশাপাশি ধরে রেখেছে।

দৈনিক দেশজনতা/এমএইচ

 

প্রকাশ :মে ২৫, ২০১৭ ৪:১৫ অপরাহ্ণ