নিজস্ব প্রতিবেদক:
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস থামছে না। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে নানা উদ্যোগ নিলেও তা কোনো কাজে আসেনি। নবম দিনের পরীক্ষাতেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। মঙ্গলবার পদার্থবিজ্ঞান এবং ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিষয়ের পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়েছে। পরীক্ষার শুরুর আগে হোয়াটসঅ্যাপে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে মূল প্রশ্নের হুবহু মিল ছিল।
এর আগে ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা প্রথম পত্রের বহুনির্বাচনি ‘খ’ সেট পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের হুবহু মিল ছিল। পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই তা ফেসবুকে পাওয়া যায়। ৩ ফেব্রুয়ারি সকালে পরীক্ষা শুরুর প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে বাংলা দ্বিতীয়পত্রের নৈর্ব্যক্তিক (বহুনির্বাচনী) অভীক্ষার ‘খ’ সেটের উত্তরসহ প্রশ্নপত্র পাওয়া যায় ফেসবুকে। ৫ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষা শুরুর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে সকাল ৮টা ৪ মিনিটে ইংরেজি প্রথম পত্রের ‘ক’ সেটের প্রশ্ন ফাঁস হয়।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি বুধবার পরীক্ষা শুরুর অন্তত ৪৮ মিনিট আগে সকাল ৯টা ১২ মিনিটে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ‘খ’ সেটের গাঁদা প্রশ্নপত্রটি হোয়াটসঅ্যাপের গ্রুপে পাওয়া যায়। ৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াটসঅ্যাপের একটি গ্রুপে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার বহুনির্বাচনী অভীক্ষার ‘খ’ সেটের চাঁপা প্রশ্নপত্রটি পাওয়া যায়। গত ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা ৫৯ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপের একটি গ্রুপে গণিতের ‘খ-চাঁপা’ সেটের প্রশ্নপত্রটি পাওয়া যায়। এ ছাড়া গত ১১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা ৫১ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপের একটি গ্রুপে আইসিটির ‘ক’ সেটের প্রশ্ন পাওয়া যায়। আর সকাল ৯টা ৩ মিনিটে ‘গ’ সেটের প্রশ্নও ফাঁস হয়। এসব ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া গেছে।
সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে: অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক
যে গেরোটা আলগা হয়ে যায় সেটা কড়া করে দিতে গেলে আরও আলগা হয়ে যায়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটা পুরো নড়বড়ে হয়ে গেছে। আমাদের যারা উচ্চশিক্ষা নিয়ে বেরিয়ে যায় তারা যে কী শিক্ষা নিয়ে যায় এ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নাই। আমরা কী পড়াই সে সম্পর্কেও কোনো ধারণা নাই। কাজেই এই শিক্ষাব্যবস্থার চরম পরিণতি প্রশ্নফাঁস; এটা হবেই, ঠেকানো যাবে না।
সরকারের কাছে এগুলো (প্রশ্নফাঁস) দিবালোকের মতো পরিষ্কার। তাই এটাকে গোড়া থেকে ঠিক না করলে প্রশ্নফাঁস চলতেই থাকবে। এই যে প্রশ্নফাঁসের চক্রটা তৈরি হয়ে গেছে সেটা পুরো ভাঙতে হবে। এই চক্র পুরোপুরি ভাঙা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় সুনির্দিষ্টভাবে জড়িত বিষয়ে যাদের নাম এসেছে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। এই অপরাধে শুধু চাকরি খেলে হবে না, আরও বড় শাস্তি দিতে হবে।
যদি কোনো মন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা ঘুষ খাচ্ছেন খান, একটু কম কম করে খান।’ এই কথার মধ্যে দিয়ে তিনি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন সেই প্রশ্ন সরকার থেকে তাকে করা হয়নি। এমনকি অন্যরাই সেই প্রশ্ন করেনি। আসলে ‘কম কম খান’ বলে তিনি কী বুঝিয়েছেন সেটা পরিষ্কার করেননি। সেখানে এ ধরনের কথা হয়, সেখানে শিক্ষাব্যবস্থা কী, কী পড়ানো হবে, তার কোনোটাই ঠিক থাকবে না এটাই স্বাভাবিক।
ভালো শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া তো আধুনিক জাতি কল্পনা করা যাবে না। কাজে এখানে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার বিষয় নয়। এই শিক্ষাব্যবস্থার কারণে একটা রাষ্ট্র থাকবে কী থাকবে না, সেই পরিস্থিতির দেখা দিয়েছে। কাজেই শক্ত হাতে প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে হবে।
প্রশ্নফাঁস বন্ধ করা সম্ভব: মোহাম্মদ কায়কোবাদ
প্রশ্নটা কখন ফাঁস হচ্ছে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোন বিষয়ের প্রশ্ন পরীক্ষা কত আগে ফাঁস হয়েছে সেটা খুঁজে দেখা দরকার। পরীক্ষার ১৫-২০ মিনিট আগে প্রশ্নফাঁস ঠেকানো খুব কঠিন ব্যাপার। কেননা তখন প্রশ্নগুলো বিতরণ হয়ে যায়। তবে আগের রাতে যদি প্রশ্নফাঁস হয় সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফেসবুকে অনেক জায়গায় ঘোষণা দিয়ে প্রশ্নফাঁস করা হচ্ছে। এটা চাইলেই বন্ধ করা সম্ভব। তবে এটাও ঠিক, একটা ফেসবুক আইডি বন্ধ করলে আরেকটা চালু করার ব্যাপার থাকে।
পরীক্ষা শুরুর আগে ৯টা বা সাড়ে ৯টায় প্রশ্নফাঁস ঠেকানোও খুব কঠিন ব্যাপার। তবে পরীক্ষার দেড় ঘণ্টা আগে প্রশ্নফাঁস হওয়াটা খারাপ। পরীক্ষার আগের রাতে যদি প্রশ্নফাঁসের কোনো ঘটনা পাওয়া যায়, সেটা গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করা যেত। আগামী দিনের প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি ফেসবুকে আগেই ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে বলে বলে ফাঁস করা হচ্ছে। এটা চাইলেই বন্ধ করা যায়।
কীভাবে প্রশ্নফাঁস বন্ধ করা যায়, সেটা নিয়ে বুয়েট থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। যেমন, প্রশ্নপত্র ছাপানোর ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা করা। এ ছাড়া প্রশ্ন বহনের ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের খাম ব্যবহার করা, যা নির্দিষ্ট সময়ের আগে খুললে বোঝা যাবে। সরকার যদি এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করে তাহলে বোঝা যেত আসলে কী হচ্ছে।
দোষীদের ফাঁসি দিতে হবে: মনির হাসান
প্রশ্ন কোথা থেকে ফাঁস হচ্ছে সেটা আগে খুঁজে বের করা দরকার। কারণ, প্রশ্ন বিতরণের ক্ষেত্রে অনেক মাধ্যম কাজ করে। একসঙ্গে সবগুলোকে ধরা সম্ভব নয়। তাই একটা সিস্টেমেটিক ওয়েতে আগাতে হবে। ঠিক কোন জায়গা থেকে প্রশ্নটি ফাঁস হচ্ছে সেটা বের করার ক্ষেত্রে সরকারের যেমন উদ্যোগ নেওয়ার কথা ছিল, সেটা বোধহয় হচ্ছে না। তাই প্রশ্নফাঁস ঠেকানো যাচ্ছে না।
ফেসবুকে প্রশ্নফাঁস করলে একটি নির্দিষ্ট আইডি থেকে করতে হবে। সেটা খুঁজে বের করা খুব কঠিন নয়। কেননা, কোনো একটি ডিভাইস থেকে সেই ফেসবুক ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটা দেশের ভেতরে হোক বা বাইরে হোক। আগে সেই জায়গাটা নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। এরপর জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওয়াতায় নিয়ে এসে কয়েকজনকে ফাঁসিতে ঝুলানো দরকার। এটা করলে আগামী দিনের প্রশ্নফাঁস বন্ধ করা সম্ভব।
প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিটিসিএলের নির্দেশে আধা ঘণ্টা সব মোবাইলের ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ে অনেক বেশি ফ্যাক্স মেশিন ব্যবহার করা হয়েছে প্রশ্ন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। তার মানে হচ্ছে, এটা ঠেকানো যাবে না। ইন্টারনেট বন্ধ করলে ফোন করে বলে দেবে। তাই প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে ইন্টারনেট বন্ধ কোনো কার্যকরী উদ্যোগ হতে পারে না।
প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে হাত দিতে হবে অন্য জায়গায়। সেটা হলো, কোন জায়গা থেকে প্রশ্নটা বের হচ্ছে, সেই জায়গাটা খুঁজে বের করতে হবে। ঠিকমতো চেষ্টা করলে এটা বের করা খুব কঠিন না। কিন্তু কেউ আসলে চেষ্টা করতেছে বলে আমার মনে হয় না। প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে যাদের ধরা হচ্ছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আসল জায়গায় যাওয়া সম্ভব। ফাইনাল লোককে বের করা কঠিন কাজ নয়। তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে এলেই প্রশ্নফাঁস ঠেকানো সম্ভব।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ