আজ ১১ জৈষ্ঠ্য জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। ১৩০৬ সালে এ দিনে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। এটা তাঁর ১১৮তম জন্মবার্ষিকী। দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো জাতীয় কবির জন্মদিন উপলক্ষে ব্যাপক, কর্মসূচী পালন করেছে। সরকারিভাবেও দিনটি পালনের কর্মসূচী আছে দিবসটি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ এডভোকেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ নেতৃবৃন্দ বাণী দিয়েছিলেন।
আমাদের জাতীয় জীবনে কাজী নজরুল ইসলামের প্রভাব ব্যাপক। বিদ্রোহের কবি ও উপমহাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে অত্যাচার নিপীড়ন শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। তাঁর লেখনী ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলেছে, মাথা উচিয়ে বৃটিশ বেনিয়া শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস যুগিয়েছে। তিনি ছিলেন চির বিদ্রোহী। তার বিদ্রোহ ছিলো অত্যাচারী শাসক-শোষক সামন্ত প্রভু, ধর্মের নামে ভাঁওতাবাজ সাম্প্রদায়িক কুপমন্ডুক, সর্বোপরি মানবতাবিরোধী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। কবি নজরুলের ক্ষুরধার লেখনী বৃটিশ সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিকে তাই পড়তে হয়েছিল বৃটিশ কোপানলে। তাঁকে জেলে যেতে হয়েছে সহ্য করতে হয়েছে নির্যাতন। কিন্তু অন্যায় অবিচার আর অসত্য, অধর্মের কাছে মাথা নত করেননি তিনি। এখানে তার অনন্য বৈশিষ্ট্য।
নজরুল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন একজন সৈনিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। সেনা বাহিনীতে থাকা অবস্থায়ই তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন বৃটিশ শাসক গোষ্ঠীর এদেশকে শাসন-শোষণের বিষয়টি। ইংরেজ বেনিয়াদের নির্মম নির্যাতন তাকে বিদ্রোহী করে তোলে। সৈনিক জীবন শেষে তিনি বেছে নেন সাংবাদিক জীবন। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘ধুমকেতু’ বৃটিশ ভারতে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। পাশাপাশি পরিণত হয়েছিল বৃটিশ সরকারের চক্ষুশূলে। ওই পত্রিকায় তিনি সর্বপ্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করলে বৃটিশ সরকার তাকে গ্রেফতার করে এক বছর কারাদন্ড দেয় এবং ‘ধুমকেতু’ নিষিদ্ধ করে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি ‘লাঙ্গল’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সাংবাদিক জীবন শুরু করেছিলেন দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে। সাংবাদিক হিসেবেও তিনি তার প্রতিভা স্বাক্ষর রেখেছেন।
কাজী নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক গল্পকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার চলচ্চিত্র নির্মাতা অভিনেতা, গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পী। একজন মানুষের মধ্যে প্রতিভার এমন সমারোহ সচরাচর দেখা যায় না। শিল্প সংস্কৃতির যে শাখা প্রশাখাতেই তিনি বিচরণ করেছেন, আপন মেধা, মনন এবং প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে করেছে ঐশ্বর্যশালী তাঁর রচিত গান আমাদের সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। গর্ব করে বলতে হয় নজরুল পরবর্তী এ যাবতকাল অবধি তাঁকে অতিক্রম করে যেতে পারেননি কোনো কবি সাহিত্যিক।
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। আমাদের দেশপ্রেমের অন্তহীন প্রেরণার উৎস। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর গান যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধা এবং অবরুদ্ধ স্বদেশের মুক্তিকামী মানুষকে সাহস যুগিয়েছে, উদ্বীপ্ত করেছে। যুগে যুগেই এমনটি ঘটেছে। যখনই শোষক গোষ্ঠীর কালো হাত অসহায় মানুষের ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নিতে উদ্ধত হয়েছে, এদেশের মানুষ ছুটে গেছে নজরুলের সৃষ্টির কাছে। তাঁর ‘কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল করার লোপাট’ কিংবা ‘শিকল পরা ছল মোদের ঐ শিকল পরা ছল, গানের বাণী তাদেরকে উজ্জীবিত করেছে শোষকের বিরুদ্ধে বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে বিদ্রোহী হতে। বিদ্রোহী সে জনতার কাছে অত্যাচারী শাসকেরা বার বার পরাস্ত হয়েছে।
আমরা তাঁকে জাতীয় কবি হিসেবে সম্মান দিয়েছি। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তিনি আজ চিরনিদ্রায় শায়িত। কিন্ত তাঁর প্রাপ্য সম্মানের পুরোটা কি আমরা দিতে পেরেছি? এদেশের একটি মহল নজরুলকে অবজ্ঞার চোখে দেখতে চায়। তারা অন্য অনেককে নিয়ে যতোটা উৎসাহী, নজরুলকে নিয়ে ঠিক ততোটাই অনুৎসাহী। এরা ভিন্ন সংস্কৃতির পুজারি। এদেরই কারণে নজরুলকে নিয়ে যথার্থ গবেষণা আজও হয়নি। নজরুল চর্চায় তারা সুকৌশলে নানাভাবে সৃষ্টি করে চলেছে বাধা-বিঘœ। ঢাকার ধানমন্ডিস্থ নজরুল ইনস্টিটিউট এখন কতোটা সচল সে প্রশ্ন তোলা অসঙ্গত নয়। কারণ, নজরুল বিষয়ে ওই প্রতিষ্ঠানটির তেমন কোনো কার্যক্রম এখন আর চোখে পড়ে না।
তারপরও কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের পথের দিশারী, ধ্রুবতারা। তাঁর আলোকিত পথ আমাদের সন্ধান দেয় শোষণ বঞ্চনাহীন সাম্যের পথ। আর সে জন্যই তিনি এদেশের মানুষের বড়ো আপন, অত্যন্ত কাছের। তিনি ছিলেন আছেন এবং থাকবেন। এই মহান কবির শুভ জন্মদিনে আমরা তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই, তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা করি।