নিজস্ব প্রতিবেদক:
নরসিংদী জেলার ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত তাঁত শিল্পের অবস্থা এখন খুবই করুণ। নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী তাঁত ও তাঁতিদের এখন আর ভালো সময় যাচ্ছে না। যন্ত্রচালিত তাঁতের সঙ্গে টিকতে না পেরে বিলুপ্তির পথে শিল্পটি। অন্যদিকে সুতানাটার অভাব, পুঁজির অভাব ও মহাজনী শোষণ ইত্যাদির কারণ। এখনও যে কয়েকজন এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন, তাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে উচ্চমূল্যের কাঁচামাল আর কমতির দিকে থাকা চাহিদার সঙ্গে। এসব কারণে অনেকেই ছেড়ে দিচ্ছেন পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া পেশাটি। যারা এখনো টিকে আছেন, মানবেতরজীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
এই তাঁতীদের উৎসাহিত করার মধ্যদিয়ে এখনো এই তাঁত শিল্পের বিকাশের সুযোগ রয়েছে। শুধু উদ্যোগ, সরকারের সদিচ্ছা এবং পুঁজির সহযোগিতার দরকার। সরকারের কাছে তাদের প্রত্যাশাও অনেক, তারা মনে করেন সরকার তাদের দিকে সুদৃষ্টি দিলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে।
জেলার প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুতা বণ্টনের সুষ্ঠু নীতিমালার অভাব, মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে সুতা কেনা, কাপড়ের ভালো মূল্য না পাওয়া- এইসব কারণে নরসিংদীর তাঁত শিল্পীরা দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছেন। নরসিংদীর ঘোড়াশালের হাজার হাজার তাঁত শিল্প আজ ধ্বংসের পথে। সেই সাথে এই শিল্পের সাথে জড়িত হাজার হাজার কর্মচারী এখন বেকার। পুঁজির অভাবে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
ঐতিহ্যবাহী ‘মসলিন’ নির্মাতাদের বংশধর এ এলাকার তাঁত শিল্পীদের কাপড় এখন আর বাজারে তেমন বিক্রি হয় না। ভেজাল রং-এর জন্য আজ তারা ক্ষতিগ্রস্ত। ক্রেতারা ঘোড়াশালের শাড়ির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
রায়পুরা উপজেলার ২৪টি ইউনিয়ন ছাড়াও জেলা সদর, বেলাব, শিবপুর, পলাশ ও মনোহরদী উপজেলায় বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য তাঁত শিল্প ছিল একসময়। তাঁতসমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে রায়পুরা পরিচিতি ও সুনাম ছিল দেশজুড়ে। রায়পুরার তৈরি তাঁতের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, বিছানার চাদর সরবরাহ হতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
জানা যায়, রায়পুরা উপজেলা সদর, হাসনাবাদ, শ্রীরামপুর, হাঁটুভাঙ্গা ও রাধাগঞ্জে গড়ে ওঠা তাঁত শিল্পকেন্দ্রিক বাজারে প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার কাপড় কেনাবেচা হতো। স্থানীয় তাঁতি ও দেশের নানা প্রান্ত থেকে নৌ ও রেলপথে আসা তাঁতের কাপড়ের পাইকারি ক্রেতাদের ভিড় লেগে থাকত নরসিংদীর হাটবাজারগুলোয়।
জেলার তাঁতিদের পেশাগত উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৮১ সালে তাঁত প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড। এখান থেকে তাঁতিদের প্রশিক্ষণ ও ঋণ দেয়া হয়। তবে অভিযোগ রয়েছে, প্রান্তিক পর্যায়ের তাঁতিরা এ ইনস্টিটিউট থেকে তেমন সুবিধা পান না। জেলা তাঁত বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, নরসিংদীতে মোট তাঁতির সংখ্যা ৭ হাজার ২৪৭ জন। এর বিপরীতে তাঁত রয়েছে ২৬ হাজার ৬৯৩টি। এর মধ্যে চালু আছে ১৪ হাজার ৮৪৫টি।
তাঁতিদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে রায়পুরার চরসুবুদ্ধি মধ্যপাড়া গ্রামের তাঁতি নজরুল ইসলাম বলেন, অনেকটা নিরুপায় হয়েই বাপ-দাদার এ পেশায় আঁকড়ে রয়েছি। বাজারে সুতা ও প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম বেশি। সে তুলনায় উত্পাদিত পণ্যের চাহিদা নেই। বেশি দামে কাঁচামাল কিনে কম দামে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে আমাদের।
একই গ্রামের তাঁতি জাহিদ হাসান ওমর বলেন, যন্ত্রচালিত তাঁতের সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হচ্ছে। যন্ত্রচালিত তাঁতে কম সময়ে বেশি পরিমাণ কাপড় বানানো যায়। সেগুলোর বুননও বেশ শক্তিশালী। এ কারণে অনেকেই হস্তচালিত তাঁতে উৎপাদিত কাপড় কম পছন্দ করছেন। বাজারে আমাদের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা নেই বললেই চলে। এমন অবস্থায় আমাদের টিকে থাকা বেশ কঠিন।
নরসিংদী তাঁত বোর্ড সূত্রে জানা যায়, দফায় দফায় সুতার মূল্যবৃদ্ধি ও পাওয়ারলুম (যন্ত্রচালিত তাঁত) শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে তাঁত শিল্প বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে। বোর্ড থেকে তাঁতিদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হচ্ছে। তাঁতিদের উন্নয়নের জন্য একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঋণ প্রদান কার্যক্রম এখনো অব্যাহত রয়েছে।
প্রবীণদের বিশ্বাস এভাবে ধীরে ধীরে আমাদের তাঁত ও তাঁতিদের জীবন ও পেশা এখন ধ্বংসের মুখোমুখি। এখনো পরিকল্পিতভাবে কাজ করলে নরসিংদীর তাঁত ও তার ঐতিহ্য ফিরে পাবে।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ