১৯শে জানুয়ারি, ২০২৫ ইং | ৫ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৯:৩২

মরে যাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের চার নদী

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি:

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা এখন গতিপথ পরিবর্তন করে দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এক সময়ের পাকা নৌ-ঘাট এখন ধু ধু বালুচর। এ অংশের পদ্মা নদী এখন প্রায় পানিশূন্য। মানুষ পায়ে হেঁটে পার হচ্ছে নিত্যদিন। নদীর বুকে এক সময় বড় বড় নৌকার আধিক্য থাকলেও এখন সেখানে দেখা মিলছে মোটরসাইকেল, সাইকেল, এমনকি গরুর গাড়িও। সেই সঙ্গে হচ্ছে চাষাবাদও। ভালো নেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্য নদীগুলোও, শিবগঞ্জের আরেক নদী পাগলাকে এখন চেনা যায় না।

ভরাট হয়ে যাওয়া পাগলায় এখন ধান আবাদে কৃষকের ব্যস্ততা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পরিচিতি যে নদীকে ঘিরে সেই মহানন্দারও করুণ অবস্থা। পানি কমতে কমতে যেন ছোট একটা নালায় পরিণত হয়েছে এ নদী। অনেক কৃষক তো মাঝ নদীতেই ধান লাগিয়েছেন। গোমস্তাপুর উপজেলার মধ্যদিয়ে বয়ে চলা পুনর্ভবা নদীরও একই চিত্র। কেন এমন মরণদশা হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রধান পদ্মা, মহানন্দা, পাগলা ও পুনর্ভবা নদীর। সে উত্তর খোঁজার চেষ্টায় ঘুরে দেখেছি নদীগুলো। কথা হয়েছে নদী পাড়ের মানুষের সঙ্গে।

শিবগঞ্জ উপজেলার পদ্মা পাড়ের মানুষগুলো মনে করেন এ নদীর করুণ পরিণতির জন্য দায়ী নদীতে পানির পর্যাপ্ত প্রবাহ না থাকা। সহজ কথায় তাদের উত্তর প্রতিবেশী দেশ ভারতের কাছ থেকে প্রয়োজনের সময় মেলে না ন্যায্য পানির হিস্যা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যও একই তথ্য মিলছে। তাদের দেয়া তথ্য বলছে, চুক্তি অনুয়ায়ী ২৭ হাজার কিউসেক পানি প্রাপ্তির কথা থাকলেও তা কখনোই পূরণ হয়নি। যার ফলে দিনে দিনে পানির অভাব দেখা দিচ্ছে নদীগুলোয়, কেউ কেউ আবার মৃতপ্রায়। পাঁকার পদ্মা ফেরিঘাটে কথা হয় পঞ্চাশ বছরের বজলুর রহমান নামে একজনের সঙ্গে, তিনি এক সময় পদ্মায় নৌকা চালাতেন, এখন কৃষিকাজ করেন। কেন পদ্মা শুকালো এমন প্রশ্নে তার সহজ উত্তর, ‘ভারত আলা পানি দ্যায় না তাই, ওদিকে চার-পাঁচটা নদী ক্যাটা পানি ট্যাইনা লিছে।’

পানিশূন্য পদ্মায় মাছ ধরতে দেখা যায় একদল তরুণকে। এদেরই একজন পদ্মা পাড়ের জ্যাটপাড়া গ্রামের ডালিম উদ্দিন। স্কুল আজ ছুটি তাই তারা মাছ ধরতে এসেছেন। কথা বলতে বলতে জানালেন, তার বাবা, চাচাসহ পরিবারের অনেকেই পদ্মায় মাছ ধরে সংসার চালাতেন। কিন্তু গত কয়েক বছর থেকেই পদ্মায় তেমন মাছ হয় না, আর এ বছর তো প্রায় পদ্মা মরেই গেছে। তাই তার বাবা ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজে গেছেন। জেলে জীবনে তেমন আয় হয় না, তাই পড়ালেখা করে অন্য পেশা বেছে নিবেন বলে জানান ডালিম।

শুকনো পদ্মায় মোটরসাইকেল নিয়ে পার হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পথ ধরেছেন রাসেল রহমান নামে এক শিক্ষানবিশ আইনজীবী। তিনি জানালেন, শুষ্ক মৌসুমে প্রতিবছরই পদ্মার বিভিন্ন অংশে চর পড়লেও এ বছরের মতো পানিশূন্য হয়ে পড়েনি। তারপর ঘুরে ঘুরে হলেও নৌকায় নদী পার হতে হত। কিন্তু এবার মোটরসাইকেল নিয়েই পার হওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, পদ্মা নদী আরো একটা অংশ এখন আছে সেটিও অনেক ছোট হয়ে গেছে যা অনেকটা নালায় পরিণত হয়েছে। সেখানে নৌকায় দুই থেকে তিন মিনিটে পার হওয়া যাচ্ছে। ভারতীয় অংশ থেকে পানি না আসার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। পদ্মাপাড়ের চরলক্ষীপুর গ্রামে দেখা হয় চরপাঁকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মতিউর রহমানের সঙ্গে।

তিনি মনে করেন ভারত সরকার যদি সঠিকভাবে পানি বণ্টন চুক্তি মেনে চলত, তাহলে পদ্মার এ পানিশূন্য হত না। তিনি বলেন, পানির ন্যায্য হিস্যা আমাদের দিচ্ছে না, অথচ বন্যার সময় আমাদের এক তরফা পানি দিয়ে তারা ডুবিয়ে দেয়, শুষ্ক মৌসুমে তাদের প্রয়োজন মিটিয়ে যেটুকু থাকে তা আমাদের দেয়, এবার অনেক কম পানি আমরা পেয়েছি তা নাহলে নদীটা শুকিয়ে গেল কেন, পায়ে হেঁটে পার হওয়া যাচ্ছে।

এতো গেল পদ্মাপাড়ের মানুষের কথা। শিবগঞ্জ উপজেলার আরেক নদী পাগলা এখন ধানের জমিতে পরিণত হয়েছে। সেখানকার এ করুণ পরিণতি নিয়ে ঢাকাস্থ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সমিতির সাবেক সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মাহতাব উদ্দীন কয়েকদিন আগে বলছিলেন, যে নদীতে সাঁতার কেটে আমি বড় হয়েছি সেটির এ করুণ মৃত্যু কষ্ট দেয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পরিচিতি যে নদীকে ঘিরে, যে নদী হতে পারতো শহুরে জীবনে খানিকটা সময়ে নির্মল শ্বাস নেওয়ার উৎস, নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর একটি উপলক্ষ, সে মহানন্দা এখন যেন মরা খাল। মহানন্দার এ করুণ মৃত্যু নাড়া দেয় শহরের মানুষকে। অন্যদিকে পুনর্ভবানদীরও একই চিত্র, সেখানেও চাষবাস করছেন কৃষকরা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মা, পাগলা, মহানন্দাসহ চার নদীর এ মরণদশার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাহিদুল ইসলাম বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার উপর প্রবাহিত পদ্মা, মহানন্দা, পাগলা নদী অন্যতম। তিনটি নদীর উৎপত্তিস্থল হল উজানের দেশ ভারতে। ১৯৭৫ সালে প্রতিবেশী দেশ ভারত এক তরফাভাবে ভারতের অংশে ১০৯টি গেট বিশিষ্ট ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরি করে। ব্যারেজ তৈরির পূর্বে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহিত হতো বাংলাদেশ অংশে ৬০,০০০ থেকে ৭০,০০০ হাজার কিউসেক। ব্যারেজ নির্মাণের পরবর্তী সময়ে বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশ পানি পেলেও শুষ্ক মৌসুমে পানি খুব সামান্য পরিমাণে পাওয়া যায়।

ভাটির দেশ হবার কারণে উজান থেকে পলি আসার ফলে পদ্মা নদীর নাব্যতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। মহানন্দা নদীর ভারতের অংশে একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণ করে প্রায় ৯০ শতাংশ পানি প্রত্যাহার করা হয় এবং ভারতের অংশে পাগলা নদীর উপর একটি স্লুইস গেট নির্মাণ করে সম্পূর্ণ পানি প্রত্যাহার করা হয়। মূলত এসব কারণেই শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলো প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পদ্মা নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে দু-টি ভাগে ভাগ হয়েছে, পাঁকা ইউনিয়নের অংশে মানুষ হেঁটে পার হচ্ছে পদ্মা। এর কারণ সম্পর্কে তিনি জানান, ভারতীয় অংশে পানি সংরক্ষণের কারণেই এমনটা হয়েছে।

আবারো চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রধান নদীগুলোর প্রাণ ফেরাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাহিদুল ইসলাম বলেন, পদ্মা নদীতে ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনা থাকলেও সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় কারিগরি কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বাদ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও মহানন্দা নদীতে নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য ৩৬.০৫ কি.মি. ড্রেজিং কাজ একনেকে পাস হয়েছে এবং পাগলা নদীতে ৪১.০০কি.মি. ড্রেজিং কাজের ডিপিপি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।

দৈনিকদেশজনতা/ আই সি 

প্রকাশ :ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৮ ১১:২৪ পূর্বাহ্ণ