নিজস্ব প্রতিবেদক:
দারিদ্র্য। অভাব। ক্ষুধা। মা-ভাই-বোনের চিন্তা। রাজ্যের অনিশ্চয়তা। একটা দিন পার হলেই পরের দিনের চিন্তা। এরই মধ্য দিয়ে চলছিল রুবিনা আক্তার (২২)-এর পড়াশোনা। এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস। এইচএসসিতেও এ প্লাস। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগে অনার্স প্রথম থেকে তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায়ও চমৎকার ফলাফল। বড় হচ্ছিল তার স্বপ্নগুলো। লক্ষ্য ছিল বিসিএস ক্যাডার বা ভালো চাকরি। কিন্তু তার
চমৎকার ফলাফলও দূর করতে পারেনি দারিদ্র্যের হতাশা। কাল হলো তা-ই। দুশ্চিন্তা ও শারীরিক দুর্বলতায় পথ চলতে গিয়ে গত রোববার দুপুরে ট্রেনে কাটা পড়লো আনমনা রুবিনা। একেবারে দুই হাঁটুর উপরের অংশে। দু’দিন আগেও যিনি নিজের পায়ে হাঁটাচলা করতেন, নিজের পায়ের উপর দাঁড়ানোর স্বপ্ন বিনির্মাণ করতেন। এক হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনায় দু’পা হারিয়ে তিনি এখন একেবারে পঙ্গু। ভেঙে গেল তার স্বপ্ন। তার জীবনও শঙ্কামুক্ত নয়। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)।
তার পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে অশ্রুতে দু’চোখ ছলছল করে উঠে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. আবু জাহেরের। তিনি বলেন, রুবিনা এখনো শঙ্কামুক্ত নয়। তাকে রক্ত দেয়া হচ্ছে। তার চিকিৎসা চলছে। পাশাপাশি দু’পা হারানোর হতাশা যাতে তাকে পেয়ে না বসে সেই মানসিক স্থিতিশীলতা দেয়ার চেষ্টাও চলছে।
গত সোমবার দুপুরে আইসিইউর ৩ নম্বর বেডে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়। শুইয়ে রাখা হয়েছে রুবিনাকে। বুক পর্যন্ত শরীর চাদরে ঢাকা। শরীরের নিচের অংশ বিছানায় লেগে আছে। বুঝাই যাচ্ছিল যে, তার দু’পা আর নেই। শয্যার কাছে যেতেই তিনি চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন। আর কোনো সাড়া নেই। কিছুক্ষণের নীরবতা। ছবি তোলার জন্য মুঠোফোন সেটটা হাতে নিতেই তিনি অস্ফুটস্বরে বলেন, ‘ছবি তোলবেন না’। এরপর মোবাইল আবার পকেটে ঢুকিয়ে নিলে তিনি দৃষ্টি সামনের দিকে ফিরিয়ে নেন। সেখানে তার সঙ্গে রয়েছেন তার চাচা মো. রফিকুল ইসলাম, তার স্ত্রী খালেদা আক্তারসহ কয়েক বন্ধু-বান্ধবী। আইসিইউর বাইরে দেখা হলো আরো কয়েক বন্ধু-বান্ধব ও মেসমেটের। তার জন্য সবার সহানুভূতি ও শুভকামনা। দাঁড়িয়ে-বসে রাত জাগা।
আইসিইউর সামনে কথা হয় রুবিনার সদরঘাটের মেসের অপর দু’ছাত্রী নাজিয়া সরকার ও মাহমুদা আফরোজের সঙ্গে। তারা দু’জনও পড়েন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। জগন্নাথে। অনার্স তৃতীয় বর্ষে। নাজিয়া ইসলাম ইতিহাসে ও মাহমুদা আফরোজ অর্থনীতিতে।
তারা বলেন, মেসে আমরা ১২ জন থাকি। আমরা দু’বছর ধরে। আর রুবিনা আপুর তিন বছর হয়েছে। তিনি এতদিন ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের একটা বৃত্তি থেকে আড়াই হাজার টাকা করে বৃত্তি পেতেন। দু’একটা টিউশনিও করতেন। তা দিয়ে সাড়ে তিন হাজার টাকার মেস খরচ চালাতেন। কিন্তু গত ডিসেম্বরে ওই বৃত্তি শেষ হয়েছে। তার আগের মাসে বন্ধ হয়ে গেছে টিউশনিও। আর ক’মাস পরে এপ্রিলে তার অনার্স চতুর্থ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। তিনি ততদিন কীভাবে চলবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতেন। এছাড়া তার পরিবারের অভাব-অনটনের কথাগুলো ঢাকতে তিনি অন্তর্মুখী হয়ে থাকতেন। মেসে বা ক্লাসে তেমন কিছু শেয়ার করতেন না। নিজের কষ্ট নিজের মনেই পুষতেন।
নাজিয়া সরকার বলেন, ক’দিন আগে তিনি আমাদের বলেন যে, আমি আর মেসের খরচ চালাতে পারবো না। তোমরা আমাকে পরীক্ষা পর্যন্ত চালিয়ে নিতে পারবে কিনা। এরপর আমি আমার এক চাচার সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করি। তিনি তাকে পড়াশুনার খরচ হিসেবে মাসে দেড় হাজার টাকা করে অনুদান হিসেবে দেয়ার সম্মতি দেন। এর বাইরে মেসের অন্যরা মিলে তাকে চালিয়ে নেয়ার সম্মতির বিষয়টি তাকে বললে সে আশ্বস্ত হয়।
তারা আরো বলেন, সব সময় পড়াশুনা, কোচিং ও টিউশন নিয়ে থাকতেন রুবিনা আপু। চাকরি ও পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। অন্যরা গল্প করলে তিনি বলতেন, গল্প করলে আমার চলবে না। আমাকে কিছু একটা করতে হবে। বিসিএস ক্যাডার বা অন্য চাকরি করতে হবে। গত বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘এই বিসিএস প্রশ্ন তো খুবই সহজ হয়েছে’।
রুবিনাকে গত রোববার দুপুরে ট্রেনে চাপা পড়ে দু’পা হারাতে দেখেন কমলাপুর রেলস্টেশনের মুচি মো. লালন। তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমি একটি চিপস কিনে খাচ্ছিলাম। এমন সময় দেখি ৬ নম্বর প্ল্যাটফরম থেকে একটি মেয়ে হেঁটে পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফরমের দিকে যাচ্ছেন। তার হাতে ও বগলে দু’টি থলে। মাথা নিচু করে হাঁটছেন। এসময় একটি ট্রেনের ইঞ্জিন ধীরে ধীরে আসছে। বৃদ্ধ চালক। হয়তো খেয়াল করেন নি। কোনো হর্নও বাজান নি। এক পর্যায়ে তাকে ধাক্কা দেয়। এরপর তার উপর দিয়ে চলে যায় চাকা। এরপর আমি দৌড়ে এগিয়ে যাই। ততক্ষণে ভিড় জমে যায়। রক্তে ভিজে যাচ্ছে। দু’পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এরপর তাকে কোলে তুলে আনতে চেষ্টা করি। আমিও ক্ষুধার্ত ছিলাম। প্রথম তিনবার চেষ্টায় তাকে তুলতে পারিনি। এমন সময় তিনি রেললাইনে বসেই দু’হাত তোলে মোনাজাত করেন। চতুর্থবারে তাকে কোলে তুলে আনতে সক্ষম হই। প্রথমে একটি বেঞ্চে বসাই। পা দু’টা বেঞ্চের নিচে রাখি। সেখানে তিনি এই খবর মা জানলে কষ্ট পাবে বলে উল্লেখ করে মোবাইলের সিম খুলে দাঁত দিয়ে কামড়ে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেন। আমি তা কেড়ে নিই। তারপর একটি ভ্যান গাড়ি ভাড়া করি। যাতে পড়ে না যায় ওই গাড়ি থেকে এ জন্য আমার জামা দিয়ে তাকে বেঁধে ফেলি। আমার জুতা তার মাথার নিচে দিই। আমার শরীর, ভ্যানগাড়ি সবকিছু তার রক্তে লাল হয়ে যায়। দীর্ঘ যানজটে দেড়ঘণ্টা চেষ্টার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছি।
জানা যায়, রুবিনা পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার কালীগঞ্জের শান্তিনগর এলাকার মৃত রবিউল ইসলামের মেজ কন্যা। ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত হয়ে রবিউল ২০১৪ সালে মারা যান। ২ বোন ও ১ ভাইয়ের মধ্যে রুবিনা মেজ। তার বড় বোন জোলেখা খাতুন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তার ছোট ভাই রুবেল হোসেন রংপুরে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে পড়ছে। তার মা রহিমা খাতুন পরের বাড়িতে কাজ করে তাদের পড়াশুনা করাচ্ছেন। তাদের বসতবাড়ি ছাড়া ছোট্ট এক টুকরো জমি আছে। তাতে আবাদ এবং গরু ও হাঁস-মুরগি লালনপালন করে সামান্য আয় দিয়ে চলছে কষ্টের জীবন।
মুঠোফোনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে রুবিনার মা রহিমা আক্তার বলেন, আমরা গরিব। তেমন জমিজমা নেই। পরের বাসায় কাজ করে কীভাবে যে সন্তানদের পড়াশুনা করাচ্ছি তা আল্লাহই জানেন। সপ্তাহ দেড়েক আগে অসুস্থ হয়ে মেয়ে বাড়িতে এসেছিল। কিন্তু পড়াশুনার কথা বলে আবার চলে যায়। আবার অসুস্থ বোধ করলে আমি তাকে বাড়িতে চলে আসতে বলি। এখন আমার মেয়ের এই অবস্থা হলে আমার তো আর কিছুই থাকলো না।
হাসপাতালে আসা তার চাচা মো. রফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী খালেদা আক্তার বলেন, তার মায়ের আগ্রহে অনেক কষ্টে রুবিনা ও রুবেলের পড়াশুনা হচ্ছে। এখন কী নিয়ে বাঁচবে পরিবারটি।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ