নিজস্ব প্রতিবেদক:
মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেয়া ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’র কঠোর সমালোচনা করেছে বিএনপি। দলটি বলছে, বহুল আলোচিত নিপীড়নমূলক আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭সহ ৫টি ধারা বিলুপ্ত করে গতকাল খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। যা আরো একটি কালো আইন হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এ আইনটি পাস হলে মানুষের বাকস্বাধীনতা বলে কিছুই থাকবে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলেও কিছু থাকবে না। সরকারের দুর্নীতি যাতে প্রকাশ না পায় বা কেউ প্রকাশ করতে না পারে সে জন্যই এ আইনটি করা হয়েছে। অনুমোদন পাওয়া আইনের খসড়ায় কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ সংক্রান্ত ৩২ ধারায় সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার হবেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আজ মঙ্গলবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব বলেন।
তিনি বলেন, ‘নতুন আইনটির খসড়ায় জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা, প্রচারণা এসবে মদদ দেয়ার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তাহলে তো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো গবেষণা বা কথাও বলা যাবে না। আওয়ামী লীগ বা সরকারের লোকজন যা বলবে তাই হবে ইতিহাস। সত্যিকার ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করে বা এ বিষয়ে কেউ মতামত দিলে তিনি অপরাধী হয়ে যাবেন। মূলত মানুষের সকল স্বাধীনতাকে হরণ করতেই এ আইনটি করা হয়েছে।’
নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে দলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
রিজভী বলেন, ‘অনুমোদন পাওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ‘কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ’ সংক্রান্ত ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার কোনো ধরনের গোপনীয় বা অতি গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা সংরক্ষণে সহায়তা করেন তাহলে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ বলে গণ্য হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শাস্তি অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। আর এই অপরাধ যদি একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার করেন বা বারবার করেন তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
তিনি বলেন, ‘আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করা হলেও প্রস্তাবিত আইনের ৩২ ধারায় হয়রানিমূলক। তাদের মতে, এ ধারার আওতায় গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে নতুন করে নিপীড়ন ও হয়রানির শিকার হতে পারেন। এ আইনে বাকস্বাধীনতাকে অপরাধে পরিণত করা হয়েছে। গণতন্ত্রকামিরাই ক্রিমিনাল হিসেবে অভিহিত হবে। ফিরে যাওয়া হবে মধ্যযুগের অন্ধকারে। এ সম্পর্কে কোনো রিরূপ মন্তব্য করা যাবে না, প্রশ্ন করা যাবে না, সমালোচনা করলে সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড হবে। আমেরিকার সংবিধানে ১৭৯১ সালে তারা বলেছিল, সংসদ বাকস্বাধীনতা খর্ব করে কোনো আইন পাস করতে পারবে না। ওটা হল গণতন্ত্র। এটা পনেরশ’, ষোলশ’ এবং সতেরশ’ সালে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানিতে বড় বড় রাজা শাসন করতেন। তারা তখন আইন করতেন রাজার ব্যাপারে, তাদের পুত্র, কন্যা, তাদের ড্রেস ও মুকুটের ব্যাপারে- কোনো বিরূপ মন্তব্য করলে শূলে চড়ানো হবে। হাজার হাজার লোককে মধ্যযুগে শূলে চড়ানো হয়েছে। মধ্যযুগ আর গণতন্ত্রের পার্থক্য হল- গণতন্ত্রে সবাই কথা বলতে পারবে। আমি নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদে পাস করা থেকে বিরত থাকার জোর দাবি জানাচ্ছি। এ মধ্যযুগীয় অমানবিক মানবতাবিরোধী আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের উদ্যোগের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানচ্ছি।’
নির্বাচন প্রসঙ্গে রিজভী বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনী আইন সংস্কারের কাজ নাকি প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে। সশস্ত্র বাহিনীকে আইন শৃঙ্খলার বাহিনীর সজ্ঞায় না রাখা, বিতর্কিত ইভিএম, ডিভিএম ছাড়া আরও কিছু বিতর্কিত বিষয় আরপিও-তে রাখা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের সাথে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের করা সুপারিশ আমলে না নিয়ে কমিশন আওয়ামী সরকারের প্রদর্শিত পথে হেঁটে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদসহ সব পর্যায়ের নির্বাচনে সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ বজায় রাখার ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে না রাখার ফলে নির্বাচনী মাঠ সমতল হবে না, ভোটাররা নিরাপদে নির্ভয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে না। সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করে নির্বাচন কমিশন যে আইন করতে উদ্যোগী হয়েছে তা নি:সন্দেহে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের অন্তরায় হবে। আমি বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরিপন্থী এই আইন প্রণয়নের উদ্যোগ থেকে সরে আসার জোরালো আহবান জানাচ্ছি। ’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘গত রোববার গাজীপুরে বিএনপির কর্মীসভায় পুলিশ বিনা উস্কানিতে নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়ে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও আহত করলেও উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে গতকাল গাজীপুরে উল্টো বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সায়েদুল আলম বাবুল, বিভিন্ন উপজেলা বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ১৪৭ জন নেতা কর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
এছাড়া সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলা জাসাসের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুলতান আহমেদকে গত রোববার গুম করা হয়েছে। এ পর্যন্ত কোথাও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে তার পরিবার-পরিজন গভীর উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছেন। আমি দলের পক্ষ থেকে অবিলম্বে তাকে খুঁজে বের করে জনসমক্ষে হাজির করার জোর দাবি জানাচ্ছি। একইসাথে অবিলম্বে গাজীপুর নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হীন ফায়দা হাসিলের মামলা প্রত্যাহারের জোর দাবি জানাচ্ছি।’
এছাড়াও ফেনীতে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সিসিটিভি নিয়ন্ত্রণাধীন স্থানে এক ছাত্রলীগ নেতা নিহতের ঘটনায় উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর অপকৌশলের অংশ হিসেবে ফেনী পৌর বিএনপি সভাপতি আলাল উদ্দিন আলালসহ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বানোয়াট ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের মামলা দায়েরের ন্যাক্কারজনক ঘটনায় দলের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের জোর দাবি করেন রুহুল কবির রিজভী।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ