১২ই এপ্রিল, ২০২৫ ইং | ২৯শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ২:১১
ব্রেকিং নিউজ

জনবান্ধব পুলিশের প্রত্যাশা পূরণ হবে কি ?

মহিউদ্দিন খান মোহন
পুলিশকে আরো জনবান্ধব হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৮ ডিসেম্বর রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধন কালে প্রদত্ত ভাষণে তিনি এ উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,আমি আশা করি প্রতিটি পুলিশ সদস্য অসহায় ও বিপন্ন মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালন করবেন এবং সাহায্যের হাত বাড়াবেন। পুলিশকে আইনের রক্ষক হিসেবে দেখার প্রত্যাশার কথাও প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন।
পুলিশের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এ উপদেশ বা প্রত্যাশা অভিনব কিছু নয়। সরকারপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রের অন্যতম একটি সংস্থা, যেটি সরাসরি জনগণের সাথে সম্পৃক্ত সেটার সদস্যদের কাছ থেকে তিনি এটা প্রত্যাশা করতেই পারেন। কেননা, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, দেশের প্রতিটি নাগরিকের জান-মালের হেফাজত এবং তাদের জীবনযাত্রা যাতে নির্বিঘœ হয়, তার দেখভাল করার গুরুদায়িত্ব তার ওপর অর্পিত। দল-মত নির্বিশেষে তিনি সবারই প্রধানমন্ত্রী। যিনি তাকে ভোট দিযে নির্বাচিত করেছেন তিনি তার যেমন প্রধানমন্ত্রী, তেমনি যিনি ভোট দেন নি বা তার প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে ভোট দিয়েছেন তারও প্রধানমন্ত্রী। ফলে তার একটি গুরুদায়িত্ব হলো দেশের সব নাগরিকের প্রতি সমআচরণ করা এবং আইনের প্রয়োগ কিংবা কোনো নির্দেশনার ক্ষেত্রে সমদৃষ্টি বজায় রাখা। সে হিসেবে পুলিশের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী যেসব উপদেশাবলী বিতরণ করেছেন তা সবার কাছেই প্রত্যাশিত বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে পুলিশকে ‘আরো বেশি জনবান্ধব’ হওয়ার পরামর্শ সবার কাছেই অত্যন্ত সময়োপযোগী নিদের্শনা বলে মনে হয়েছে। কারণ, সাম্প্রতিককালে আমাদের পুলিশ বাহিনীর কতিপয় সদস্যের ক্রিয়াকা- এ বাহিনীটিকে বিতর্কিত করে তুলেছে। মানুষ এখন ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’ কথাটি এক রকম ভুলতে বসেছে। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা জনস্বার্থবিরোধী বলেই মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পুলিশের এক শ্রেণীর সদস্যের কাজকর্ম আচরণ এমন পর্যায়ে গেছে যে, পুলিশ শব্দটি শুনলেই এখন অনেকে আঁৎকে উঠেন। বিপদে আপদে এখন আর কেউ সহজে পুলিশের দ্বারস্থ হতে চায় না। বরং ‘ আবার কোন ঝামেলায় পড়ি’- এ চিন্তা করে পুলিশকে এড়িয়ে চলাই অনেকে শ্রেয় মনে করে। জনমনে পুলিশ সম্পর্কে এ নেতিবাচক ধারণা এক দিনে বা হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতিবাজ কতিপয় পুলিশ সদস্যের কারণে এ বাহিনীটি আজ একটি বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
অতীতের ঘটনা না হয় নাইবা উল্লেখ করলাম। অতি সম্প্রতি যে ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দবিন্দুতে আবস্থান করছে, সেটা নিয়েই একটু কথা বলা যাক। পুলিশের একজন ডিআইজি হয়ে মিজানুর রহমান লাম্পট্য, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অসাধুতার যে নজির স্থাপন করেছে, তা কি কল্পনা করা যায়? পুলিশের কাছে মানুষ বিপদে সাহায্য সহায়তার জন্য গিয়ে থাকে। দুর্বৃত্তদের হাত থেকে বাঁচতে মানুষ পুলিশের কাছে দৌঁড়ে যাবার কথা। কিন্তু সে পুলিশেরই একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাাই যখন দুর্বৃত্তের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন সাধারণ মানুষের যাবার কোনো জায়গা আর অবশিষ্ট থাকে কি? একজন মানুষ কতটা চরিত্রহীন হলে জোর পূর্বক একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে বিয়ে করতে পারে, তারপর সে মেয়ে স্ত্রীর দাবিতে সোচ্চার হলে তাকে হত্যাসহ নানা ধরণের হুমকি দিতে পারে, তা কল্পনা করা যায়! শুধু তাই নয়, তার সে লাম্পট্যের খবর প্রকাশ করায় দু’জন সাংবাদিককে দেখে নেয়ার হুমকি পর্যন্ত সে দিয়েছে! অথচ তার বিরুদ্ধে সরকার এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। এ পর্যন্ত ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে তাহলো, তাকে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনারের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে সংযুক্ত করা হয়েছে। এটা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, নাকি ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার লক্ষ্যে আই ওয়াশ তা বোধগম্য নয়। কেননা, যে গুরুতর অভিযোগ ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে উঠেছে, তাতে প্রথম পদক্ষেপে তাকে বরখাস্ত করা দরকার ছিল। কেননা, সে তার অপকর্মের দ্বারা পুলিশ সদস্য হিসেবে চাকরিতে যোগ দেয়ার পর যে শপথবাক্য পাঠ করেছিল তা ভঙ্গ করেছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ আনা যায়। এক. নারী অপহরণ । দুই. জোর করে বিয়ে। তিন. ধর্ষণ (যেহেতু সে বিয়ের কথা অস্বীকার করেছে, অথচ চার মাস মেয়েটির সাথে বসবাস করেছে)। চার. ওই মেয়েটি এবং দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশনের দু’জন সাংবাদিককে হুমকি দেয়া। এসব অভিযোগে ডিআইজি মিজানকে সরাসরি গ্রেফতারও করা যেত।
কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে? দেখা যাচ্ছে গ্রেফতার তো দূরের কথা, তাকে এখনও চাকরিতে বহাল রাখা হয়েছে। এমনকি যমুনা টিভি ও যুগান্তরের সাংবাদিকদ্বয় ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করতে চাইলেও পুলিশ তা গ্রহণ করে নি। এই জিডি গ্রহণ না করাকে অনেকেই ডিআইজি মিজানকে রক্ষার জন্য পুলিশ প্রশাসনের সুকৌশল কায়দা বলে মনে করছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ডিআইজি মিজান যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে, তা যদি দেশের অন্য কোনো সাধারণ মানুষ ঘটাতো তাহলে কি পুলিশ প্রশাসন তথা সরকার এমন নির্বিকার থাকত?
অনেকেই মনে করছেন ডিআইজি মিজান প্রলিশের চাকরিতে বহাল থাকলে তার বিরুদ্ধে অনীত অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত হবে না। সে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে বসে তদন্ত কাজকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে। তাছাড়া সে যে ভাষায় এখনও কথাবার্ত বলছে তাতে এটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, তার পেছনে শক্তিশালী কোনো খুটা আছে। কারণ খুটার জোরেই ম্যাড়া কুঁদে। যমুনা টেলিভিশনে প্রচারিত ওই মেয়েটির সঙ্গে তার মোবাইল ফোন কথোপকথনের অডিও যারা শুনেছেন, তারা বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী এবং দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত একটি সংস্থার উচ্চপদস্থ একজন ব্যক্তির মুখের ভাষা এতটা কদর্য হতে পারে তা কল্পনাও করা যায় না। ডিআইজি মিজানের সে অশ্লীল কথাবার্তার অডিও ক্লিপ সরকারের উচ্চ পর্যাযের কর্তাব্যক্তিদের কাছে পৌঁচেছে কীনা জানি না। তবে, তাদের উচিত তা সংগ্রহ করে শোনা এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আগেও ছিল। পুলিশ ঘুষ খায়, ঘুষ খেয়ে আসামী ছেড়ে দেয়, ভালো মানুষদের হয়রানি করে, এ ধরণের অভিযোগ আগেও পাওয়া যেত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এ বাহিনীটির কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ দুর্নীতিসহ নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধের যেসব খবরা খবর সংবাদ মাধ্যমে এসেছে, তাতে সমাজ ব্যবস্থায় ভয়াবহ ধ্বস নামার আশঙ্কা করছেন অনেকে। সংবাদ মাধ্যমেই খবর বেরিয়েছে, গত সাত বছরে পুলিশের বিরুদ্ধে প্রায় সাত হাজারেরও বেশি অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিন্তু সেসব অভিযোগের বেশির ভাগই চাপা পড়ে গেছে, কোনো তদন্ত হয়নি। আর যেগুলোর তদন্ত হয়েছে সেগুলোও দায়সারা গোছের। হাতে গোণা দু’চারটি ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও তা উল্লেখযোগ্য নয়। মজার বিষয় হলো, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্তও করে আরেক পুলিশ। ফলে সহকর্মী বা অধঃস্তনকে রক্ষার একটা প্রয়াস তদন্তকারীদের মধ্যে থাকাটা অস্বভাবিক নয়। এজন্য সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে প্রতিনিয়ত দাবি জানানো হচ্ছে পুলিশের অপরাধের তদন্ত অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে পরিচালনা করার। কিন্ত এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয় নি।
একজন ডিআইজি মিজানের খুঁটির জোর কোথায় তা নিয়েও কথা উঠেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদিও বলেছেন অভিযোগের তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে, তা কতটা বাস্তব রূপ লাভ করবে তা নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ রয়েছে। কারণ, তার বিরুদ্ধে থানা জিডি গ্রহণ করছে না। থানা কেন এ আচরণ করছে, তাও তলিয়ে দেখা দরকার। যে কোনো নাগরিকের যে কোনো অভিযোগ থানা পুলিশের গ্রহণ করার কথা। তাহলে কি মিজানুর রহমান ডিআইজি বলেই থানা এ অনীহা প্রকাশ করছে? বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের জানা আছে কীনা জানি না। তবে, যেহেতু বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে, তাই এ বিষযে তার যথাযথ নজর দেয়া আবশ্যক।
প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা কীভাবে এমন জঘন্য অপরাধে শামিল হতে পারে! নৈতিক স্খলন কতটা হলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা পেশাদার দুর্বৃত্তের মতো অপরাধকর্মে প্রবৃত্ত হতে পারে তা অনুমান করা কষ্টকর নয়। লোভ যখন মানুষকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তখন তার বিবেক বুদ্ধি অনেকটাই লোপ পায়। তিরোহিত হয় ন্যায- অন্যায় পার্থক্য করার বোধশক্তি। আর ক্ষমতাও অনেককে অন্ধ করে দেয়। ডিআইজি মিজান তার পুলিশি ক্ষমতার কারণে যে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে নিজেকে মহাশক্তিধর ভেবেছিল এবং হয়ত ধরেই নিয়েছিল তার এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটি করারও সাহস পাবে না। সে হয়ত এটাও ভেবেছিল যে, এসব ঘটনা ধামাচাপা দেয়া যাবে এবং তার পাপ লুক্কায়িত থেকে যাবে। কিন্তু সব যাত্রায় এক ফল হয় না। ক্ষমতার অপব্যবহার এবং নৈতিক স্খলনের জন্য আজ সে আসামীর কাঠগড়ায়।
প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ প্রশাসন তথা সরকার কি একজন ডিআইজি মিজানকে রক্ষা করবে, নাকি পুলিশের ভাবমর্যাকে সমুন্নত রাখতে পদক্ষেপ নেবে। একজন মিজানের জন্য গোটা পুলিশ বাহিনী আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। শুধু একজনই নয়, এমন শ’ শ’ মিজান আছে আমাদের পুলিশ বাহিনীতে, যাদের কারণে পুলিশ আজ ইমেজ সঙ্কটে। এটা ঠিক যে, পুলিশ প্রশাসনের ভেতরে ডিআইজি মিজানের শুভাকাঙ্খি কেউ কেউ থাকতে পারে। তারা হয়ত চেষ্টা করবে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে তাকে রক্ষা করতে। তবে, সরকারকে স্মরণে রাখতে হবে, ঘটনাটি দেশবাসীর গোচরে আছে। এ ঘটনা যদি ধামাচাপা দেয়া হয় বা গুরুপাপে লঘুদন্ডের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে সরকারের ইমেজই নষ্ট হবে। প্রমাণিত হবে সরকার দুষ্টের লালনে তৎপর।
পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী পুলিশকে আরো জনবান্ধব হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন। দেশবাসীও চায় পুলিশ জনগণের বন্ধু হোক। তারা আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠুক জনবান্ধব পুলিশ। তবে, তার আগে ডিআইজি মিজানের মতো যেসব ব্ল্যাক শীপ পুলিশ বাহিনীতে আছে তাদেরকে খুঁজে বের করে এ বাহিনীটিকে পরিষ্কার করতে হবে। অবশ্য এ জন্য প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সরকার যদি সে রকম মনোভাব নিয়ে কাজ শুরু করে তাহলে পুলিশ জনবান্ধব হওয়ার পথে অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারবে। অন্যথায় কথা বলাই সার হবে, কাজের কাজ কিছুই হবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

প্রকাশ :জানুয়ারি ১৭, ২০১৮ ৫:২১ অপরাহ্ণ