আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
পুরো যুক্তরাষ্ট্র থেকে অবৈধ এবং কাগজপত্রহীনদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর মহোৎসব চলছে যুক্তরাষ্ট্রে। সেই ডিপোর্টেশন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি খড়গ নামছে অবশ্যই মেক্সিকোসহ যেসব দেশের অবৈধ নাগরিক বেশি তাদের ওপর। এর প্রভাব বাংলাদেশিদের ওপরেও পড়ছে দারুণভাবে। সর্বশেষ, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীকে ডিপোর্টেশন সেন্টারে পাঠিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস পুলিশ-আইস।
পারিবারিব সূত্রে জানা যায়, আরজু নামের ওই রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে গিয়েছিলেন ইমিগ্রেশন আদালত দপ্তরে। যেখানে তার কাগজপত্রের বৈধ আবেদন দায়ের করা ছিল। যাদের এমন কাগজপত্রের সমস্যা আছে তাদেরকে নিয়মিত তারিখ অনুযায়ী হাজিরা দিতে হয় ইমিগ্রেশন পুলিশের দপ্তরে। আরজুর স্ত্রী এবং তাদের একটি কন্যাসন্তান আছে, যারা এই দেশের নাগরিক। কিন্তু আরজুর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা ছিল আরো ১০ বছর আগে। সে সময় এক আমেরিকান নারীকে বিয়ে করেছিলেন তিনি, কিন্তু পরবর্তীতে তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেন। ওই নারী আদালতে প্রতারণার মামলা করে রেখেছিলেন। এতদিন ধরে রিয়েল এস্টেট ব্যাবসায়ী আরজুর এই দেশে থাকা-খাওয়া এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করার পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়নি। এমনিক স্ত্রী-সন্তানেরও আমেরিকান পাসপোর্ট আছে। তারপরও রেহাই হলো না তার। ইমিগ্রেশন পুলিশ দপ্তরে হাজিরা দিতে যান যেদিন, সেদিন-ই তাকে ডিপোর্ট করা হয় বলে জানা গেছে পারিবারিক সূত্রে। এই আরজুদের সংখ্যা নেহায়েত-ই কম নয়।
২০১৭ সালে প্রথম ধাপে ১১ জন এবং পরের ধাপে আরো ২৭ জনকে ডিপোর্ট বা দেশে ফেরত পাঠানো হয় বলে নানা সূত্রে খবর পাওয়া যায়। যেহেতু এই ডিপোর্টেশন প্রক্রিয়াটি ঘটে দ্রুত এবং কাগজপত্রহীনদের পরিবারের তরফে সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার বিষয় থাকে, তাই অনেকেই বিষয়টি জানাতে চান না। সে কারণে খুব বেশি জানার সুযোগ থাকে না যে, মোট কতজনকে এই প্রক্রিয়ায় দেশে পাঠানো হচ্ছে বা হয়েছে।
রিয়াজ তালুকদার নামের আরো একজন ব্যক্তি, যাকে দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ জারি হলে তিনি গণমাধ্যম আর স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীদের দ্বারস্থ হন। এরপর তাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রচারিত হয় এবং আন্দোলন জোরদার হয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে ইমিগ্রেশন পুলিশের দপ্তর তাকে ৬ মাসের বাড়তি সময় দিয়ে আইনি প্রক্রিয়া শুরুর সুযোগ দেয় গেল থ্যাঙ্কস গিভিং দিবসের আগে।
সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, রিয়াজ তালুকদারের পুরো আইনি প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু হয়েছে, যেখানে এই দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদনপত্রটি আবার শুনানির অপেক্ষায় আছে। এটি সম্ভব হয়েছিল, আমেরিকার মূলধারার গণমাধ্যমের সোচ্চার অবস্থান আর রিয়াজের পক্ষে হাজারো মানুষের সরব প্রতিবাদের কারণে। সব প্রতিবাদ যে হালে পানি পায় তেমনটি নয়। রিয়াজ তালুকদারের ডিপোর্টেশন ঠেকাতে মাঠে তৎপর ছিলেন এমন একজন মানবাধিকার কর্মী যার নিজেরও ডিপোর্টেশন আদেশ ছিল বেশ কয়েক বছর আগে।
রাজীব রাগবীর নামে ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগোর একজন নাগরিক যিনি আইনের ম্যারপ্যাঁচে পড়ে ডিপোর্টেশন আদেশ পান, কিন্তু পরে তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে সেই ডিপোর্টেশন আদেশ স্থগিত করতে পারার পর, নিজেই একটি সংগঠন দাঁড় করান এমন আইনি ম্যারপ্যাঁচে পড়া ডিপোর্টেশন নির্দেশপ্রাপ্ত অভিবাসীদের মানবাধিকার লড়াই করার জন্য।
রাজীব রাগবির নামের ওই মানবাধিকার কর্মীকেই আইস পুলিশ ধরে ডিপোর্ট করার জন্য ফ্লোরিডায় তাদের ডিটেনশন সেন্টারে পাঠিয়ে দিয়েছে গত ১০ জানুয়ারি। সেখানে যদিও এখন তার ডিপোর্ট অর্ডার ঠেকানোর চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে বিভিন্ন সংগঠনের তরফে। তার দেশে ফেরা ঠেকানো গেলে সেটা হবে একটি ব্যতিক্রম।
এইসব ভিন্ন ভিন্ন খবরের বাইরে আরো খবর হলো, ৯ জানুয়ারি একযোগে যুক্তরাষ্ট্রের ৯৮টি সেভেন ইলিভেন স্টোরে গভীর রাতে অতর্কিত হানা দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। ওই রাতে বড় বড় অভিবাসীর শহরগুলোতেই মূলত অভিযান চালিয়ে দেখেন যে কাগজপত্রহীনরা কাজ করছে কি না। ২১ জনকে নানা স্থান থেকে গ্রেফতারও করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। নিউইয়র্কের অন্তত ৩টি স্টোরে সেদিন অভিযান চলেছে। এভাবে বাংলাদেশি মালিকানাধীন কয়েকটি রেস্টুরেন্ট আর গ্রোসারি দোকানেও অভিযান হয়েছে ২০১৭ সালে। সব মিলিয়ে ভয় আর আতঙ্কে এখন কাগজপত্রহীন অভিবাসীরা। অথচ, এরা এক সময় বিশ্বাস করতেন, যতদিন নিউইয়র্ক শহর আছে, ততদিন তারা বাস করবেন এক অভয়ারণ্যে। সেই দিন উল্টে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের বছর শেষের খবর হলো, আড়াই লাখ মানুষকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে ইমিগ্রেশন এন্ড কাস্টমস পুলিশ। ২০১৭ সালের বছর শেষের সফলতার হিসাব দিতে গিয়ে এই তথ্য জানায় ইমিগ্রেশন এন্ড বর্ডার পেট্রোল পুলিশ দপ্তর। এটা একটা বড় সফলতা প্রশাসনের চোখে। সেই সফলতার ভেতরের গল্পগুলো বেশ করুণ আর বেদনাদায়ক প্রতিটি ডিপোর্ট হওয়া পরিবারের জন্য। যেই খড়গ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না বাংলাদেশিরাও।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ