আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
মাদ্রাসা শিক্ষক আসিফুল ইসলামের আব্বা, দাদার জন্ম এই আসামে। অথচ এখন বিজেপির লোকজন বলছে, তাদের অচিরেই বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে! মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা আসিফুলের। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে আসিফুল জানিয়েছেন, ‘বাপ-দাদারা অশিক্ষিত ছিলেন। জমির দলিল পর্যন্ত ঠিকমতো সংরক্ষণ করতে পারেননি। এই সুযোগে আমাদের দেশছাড়া করার চেষ্টা করছে বিজেপি সরকার।’
শুধু আসিফুল নন, এমন ২০ লাখ বাঙালি মুসলমানের বাস আসামে। এই পুরো স্থানীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দীর্ঘদিন থেকে উচ্ছেদের হুমকি দিয়ে আসছিল স্থানীয় সাম্প্রদায়িক হিন্দু গোষ্ঠীগুলো। সর্বশেষ সংসদীয় নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতায় এলে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন বেড়ে যায় বহুগুণ। এরই ধারাবাহিকতায় এখন আসামের স্থানীয় মুসলমানদের বাংলাদেশে পুশ-ইন করাতে চাইছে বিজেপি সরকার। স্থানীয় বাঙালি মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে প্রায় ৬০ হাজার নিরাপত্তারক্ষীর সমাবেশ ঘটিয়েছে বিজেপি সরকার।
স্থানীয় মুসলমানদের জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার খায়েশ বিজেপির বহুদিনের। তবে স্থানীয় মুসলমানরাও নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে কোথাও যাবে না মর্মে চোয়ালবদ্ধ। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে কী প্রস্তুতি নিচ্ছে? আমাদের সরকার আদৌ কি জানে ভারতের এই অপতৎপরতার বিষয়ে? মিয়ানমারের বৌদ্ধ সন্ত্রাসী আর সেনাবাহিনীর অত্যাচারে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম যখন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, তখন ভারতের বিজেপি সরকারের এই আচরণ বাংলাদেশের জন্য জন্ম দিচ্ছে আরেক সংকট।
দীর্ঘদিন থেকে বিজেপি বলে আসছে, আসামের মুসলমানরা বাংলাদেশ থেকে সেখানে গিয়ে অবৈধভাবে বসবাস করছে। অথচ ইতিহাস বলে, বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা ইতিহাসের নানা সময়ে ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাতে গিয়ে বসবাস শুরু করে। সবচেয়ে বড় স্থানান্তর ঘটে ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হলে। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ থেকে আমরা জেনেছি, ১৯৪৭ সালে বাঙালিদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর ভারতের জহরলাল নেহেরু আর ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের কারসাজিতে সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি। আমাদের সাথে প্রতারণা করে, পাকিস্তানের সাথে পূর্ববঙ্গকে ট্যাগ করে দেয়া হয়। অথচ কথা ছিল কলকাতা, দার্জিলিং, আসামের করিমগঞ্জ, কাছার এবং বর্তমান বাংলাদেশের ভূখণ্ড নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র হবে। এই রাষ্ট্রের মানুষ পরে গণভোট দিয়ে ঠিক করবে, তারা ভারত না পাকিস্তানের সাথে যাবে। কিন্তু দিল্লিতে কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের বড় বড় লিডাররা গোপনে মিটিং করে আমাদের সাথে প্রতারণা করে।
নিজেদের করাচি-লাহোরের গুরুত্ব কমে যাবে বলে জিন্নাহ কলকাতাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চাননি, আর কলকাতা ছেড়ে দিলে পশ্চিমবঙ্গের আর থাকে কী, এই জন্য পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু এলিটরা কলকাতা ছাড়তে রাজি হয়নি। পাকিস্তান আর ভারতের স্বার্থান্বেষীরা এক হয়ে আমাদের সাথে প্রতারণা করে। আসামের মুসলমানরা নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে পাকিস্তানে আর মাইগ্রেট করেনি। ইতিহাসের সেই প্রতিশোধই এখন নিতে চাইছে অন্ধ হিন্দুত্ববাদের দল বিজেপি।
বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের মুসলমানদের জীবনে দুর্দশা শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সেন্টারের সর্বশেষ তালিকায়, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচারে ভারতকে বিশ্বের চতুর্থ রাষ্ট্রের স্থানে রাখা হয়েছে। বিজেপি ক্ষমতায় এসে ভারতবর্ষের পুরো ইতিহাস বদলে ফেলার চেষ্টা করছে। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের সমস্ত অবদানকে অস্বীকার করে বিকৃত ইতিহাস লিখতে চাইছে বিজেপি সরকার। তাজমহলের নাম পাল্টে বিজেপি বলছে ‘তেজোমহল’। তাজমহলকে মন্দির বানিয়ে সেখানে নিয়মিত পূজা-অর্চনা করার ঘোষণা বহু আগেই দিয়েছে বিজেপি। বিজেপি এতটাই আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে যে, মানবতাবাদী নেতা মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নথুরাম গডসের মন্দির পর্যন্ত বানিয়ে ছেড়েছে তারা। ভারতবর্ষের অন্যতম শান্তিপ্রিয় এবং প্রগতিশীল রাজ্য ত্রিপুরাতেও বিজেপি ধীরে ধীরে তার কালো ছায়ার বিস্তার ঘটাচ্ছে। কদিন আগেই বিজেপির এক নেতা ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কিংবদন্তীর বাম নেতা মানিক সরকারকে ভারতছাড়া করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কারণ মানিক সরকার এবং তাঁর মত লাখ লাখ বাঙালির আদি নিবাস এই বাংলাদেশে।
হিন্দু ধর্মের অনুসারী হওয়ায় মানিক সরকার কিংবা হিন্দু বাঙালিদের হয়তো ভারতবর্ষ ছাড়তে হবে না। এ বিষয়টি বিজেপি সরকার ইতোমধ্যে ক্লিয়ার করে বলেছে। বিজেপির ভাষায়, যারা ‘নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে যাবে, তাদের আশ্রয় দেয়া হবে’। বিজেপির এই ঘোষণার মধ্যেই নোংরা, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে। বিজেপি বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের ভাগিয়ে নিতে চায়। স্থানীয় ভারতীয় মুসলমানদের বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে, ফাঁকা জায়গা বাংলাদেশের হিন্দুদের দিয়ে ভরাতে চায় বিজেপি।
কিছু হলেই বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে দোষারোপ করে সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ নয়, মর্মে প্রচার করে ভারতের বিজেপি এবং এর এদেশীয় প্রতিনিধিরা। অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের এবং এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সম্মান সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে নানা অফিস-আদালতে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উজ্জ্বল উপস্থিতি প্রমাণ করে বাংলাদেশ মুসলমানদের কোনো রাষ্ট্র নয়। এমনকি শুধু বাঙালিরও নয়। অবাঙালি নানা জাতিগোষ্ঠী এদেশে বিশেষ মর্যাদা নিয়ে বসবাস করছে। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অংশ বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ভারতে ভূসম্পত্তি গড়ে তুলেছে। একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে এই শ্রেণির হিন্দু লোকজন বাংলাদেশে থাকে। চাকরি করে, ব্যবসা করে। ছেলে-মেয়েদের আগে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। পরে সময় বুঝে নিজেরাও ভারতে চলে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হিন্দু প্রফেসরকে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি, যিনি নিজের চাকরির অর্থ দিয়ে কলকাতায় বিশাল বাড়ি বানিয়েছেন।
বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ এবং হিন্দুদের জন্য অনিরাপদ প্রমাণ করার জন্য বিজেপির প্রচারাভিযান দীর্ঘদিনের। বিজেপির বাংলাদেশি অনুসারীদের রাষ্ট্রদ্রোহ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এরা বাংলাদেশে থেকে ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলে স্লোগান দেয়। অতীতে এ নিয়ে বহু লেখায় এমন রাষ্ট্রদ্রোহের প্রমাণ আমি দিয়েছি। এই বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারের পাশাপাশি আসামে চলছিল ‘অনুপ্রবেশকারী’দের তালিকা প্রণয়নের কাজ। এই তালিকা রোববার প্রকাশ করার কথা।
ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস (এনআরসি) শীর্ষক এই তালিকা প্রণয়নের কাজ ইতোমধ্যে শেষ করে এনেছে বিজেপি সরকার। ১৯৫১ সালের পরে এ ধরনের তালিকা প্রণয়নের কাজ ভারতে এই প্রথম। আসামের অর্থমন্ত্রী এবং তালিকা প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘আসামে বসবাস করা অবৈধ বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করতে এই তালিকা প্রণয়ন করা হচ্ছে। যাদের নাম এই তালিকায় থাকবে না, তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে’।
বিজেপির একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী বাংলাদেশ নাম উচ্চারণ করে মিথ্যাচার করেছেন। এ বিষয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, ‘ভারত সরকারের এমন কোনো পরিকল্পনার কথা বাংলাদেশ অফিসিয়ালি বা আনঅফিসিয়ালি কোনোভাবেই জানে না।’ ভারত সরকার দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের বাংলাদেশবিরোধী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে আসছে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে, প্রকাশ্য হোক, গোপনে হোক, এর শক্ত প্রতিবাদ করা। মিয়ানমারের ৮ লাখ রোহিঙ্গার ভার নিয়ে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ভয়াবহ উভয় সংকটে আছে। আসামের একটা মানুষও যেন অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, সে দিকে বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কড়া সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার।
বাংলাদেশ কোনো দুর্বল রাষ্ট্র নয়। আইনি যুদ্ধে ভারত ও মিয়ানমারকে হারিয়ে বিশাল সমুদ্র সীমা অর্জন করে বাংলাদেশ নিজেদের শক্তিমত্তার বড় স্বাক্ষর রেখেছে। বাংলাদেশে লাখ লাখ ভারতীয় চাকরি ও ব্যবসা করে নিজেদের জীবিকা অর্জনের পাশাপাশি নিজ দেশে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করে। রেমিট্যান্স অর্জনের দিক থেকে বাংলাদেশ ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম উৎস। বাংলাদশের বিজিবি (আগের বিডিআর), র্যাব এবং পুলিশ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে সীমান্ত এলাকা থেকে নির্মূল করে ভারতের অখণ্ডতা রক্ষায় বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একমাত্র ‘নিরাপদ’ প্রতিবেশী বাংলাদেশ। তাই কূটনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগ করার পাশাপাশি আপাতত আসাম সীমান্তে বিজিবির তৎপরতা বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশের মিডিয়াগুলোকেও সতর্কতার সাথে এ ধরনের সংবাদ বেশি বেশি প্রচার করে সুষ্ঠু জনমত তৈরি করে নীতি নির্ধারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। বঙ্গবন্ধু আমাদের রাষ্ট্র উপহার দিয়ে গেছেন, এখন এ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ