নিজস্ব প্রতিবেদক:
এ বছর টানা বৃষ্টি ও দেশজুড়ে দফায় দফায় বন্যার কারণে প্রায় ৫০ শতাংশ আমন চাষ নষ্ট হয়ে গেছে। তার ওপর শেষ বর্ষায় উজান থেকে নেমে আসা ঢলে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বন্যায় আমনের তে তলিয়ে যায়। এর পরও টিকে থাকা ধানে হয়েছে পোকার আক্রমণ। ফলে এ বছর আমনের উৎপাদন তুলনামূলকভাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হবে বলে আশঙ্কা করেছেন কৃষি বিশেষজ্ঞেরা। তবে সরকারের কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃষ্টি, বন্যা ও পোকার আক্রমণে আমনের ব্যাপক ক্ষতি সত্ত্বেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক পরিমাণ জমিতে আমন চাষ হওয়ায় উৎপাদন ঘাটতির অনেকটাই পুষিয়ে যাবে। তা ছাড়া বন্যার কারণে জমিতে অতিরিক্ত পলিমাটি পড়ায় আমনের ফলনও গত বছরের চেয়ে ভালো হয়েছে। ফলে আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।
এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ) মোশাররফ হোসেন নয়া দিগন্ত বলেন, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত প্রায় দেড় লাখ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছে। তা ছাড়া এ বছর আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমনের যে ক্ষতি হয়েছে- তা পুষিয়ে নেয়া যাবে। তবে এ বছর উৎপাদন কত হয়েছে তা এখনোই বলা যাবে না। কারণ এখনো আট ভাগ আমন কাটা সম্ভব হয়নি। ফলে পুরোটা কাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কতটুকু অর্জিত হয়েছে, তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই সারা দেশে আমন কাটা শুরু হয়েছে। আগামী মাসের মাঝামাঝিতে অর্থাৎ মধ্য জানুয়ারির দিকে আমনের উৎপাদনের পুরো হিসাব জানা যাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেয়া সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছর (২০১৭-১৮) সরকারি হিসাবে ৫৭ লাখ ৭৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আমনের চাষাবাদ হয়েছে। অথচ এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫৬ লাখ ১৫ হাজার হেক্টর। এতে আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক কোটি ৪০ লাখ ৭৬ হাজার ৪০০ টন। যার গড় ফলন ধরা হয়েছে হেক্টরে আড়াই টন। এর মধ্যে রোপা আমন (হাইব্রিড) ৯৫ হাজার হেক্টর জমিতে তিন লাখ ৩২ হাজার টন। যার গড় ফলন সাড়ে তিন টন। উফশী আমন ৪১ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে আমনের উদপাদন লক্ষ্যমাত্রা এক কোটি ১৫ লাখ ৫৬ হাজার টন। গড় ২.৮০ টন। স্থানীয় ১০ লাখ ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১৮ লাখ ১৯ হাজার টন। গড় ফলন ১.৬৮ টন।
মোট রোপা আমন ৫৩ লাখ পাঁচ হাজার হেক্টরে এক কোটি ৩৭ লাখ আট হাজার টন। গড় ২.৫৮ টন। আর বোনা আমন তিন লাখ ১০ হাজার হেক্টরে তিন লাখ ৬৮ হাজার ৯০ টন। গড় ১.১৯ টন। অথচ গত বছর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৫ লাখ ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে চাষের বিপরীতে ধান হয়েছিল এক কোটি ৩৬ লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন। তারও আগের বছর ২০১৫-২০১৬ সালে সারা দেশে ৫৫ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছিল। ওই বছর ধানের উৎপাদন ছিল এক কোটি ৩৪ লাখ ৮৩ হাজার মেট্রিক টন। পরের বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উৎপাদন কী পরিমাণ হয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি। জানুয়ারি নাগাদ পুরো তথ্য পাওয়া যাবে।
এ দিকে আমন ধান উঠলে চালের দাম আরো কমবে বলে আশা করা হলেও নতুন চালের দাম কমেনি ঢাকার বাজারে, উল্টো দাম কিছুটা বাড়ার কথা জানিয়েছেন বিক্রেতারা। বিগত বছরগুলোর চেয়ে ধানে বাড়তি দাম পাওয়ায় কৃষকেরা খুশির কথা বললেও বাঙালির প্রধান এই খাদ্যপণ্যের দাম আরো বাড়তে পারে বলে শঙ্কা করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। গত বছর এ সময় আমনের নতুন চাল পাইকারিতে প্রতি কেজি ৩২ টাকা থেকে ৩৪ টাকার মধ্যে ছিল। এবার সেই চাল ৪০ থেকে ৪১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন আমন ধান থেকে উৎপন্ন মোটা চালের দাম ৫০ কেজির বস্তা দুই হাজার টাকা থেকে বেড়ে ২০৫০-২০৭০ টাকায় পৌঁছেছে।
মোটা চালের সাথে পাল্লা দিয়ে অন্যান্য চালও বস্তায় ৫০ টাকা করে বেড়েছে গত এক সপ্তাহে। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সব ধরনের চালে ৫০ কেজির বস্তায় ৪০০ টাকা করে বেড়েছে।
চালের দাম আরো বাড়ার আশঙ্কা জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেন, গত কয়েক মাস ধরে চালের দাম বাড়লেও আমন ধান উঠলে অন্য সব বারের মতো এবারো চালের দাম কমবে, এমনটাই ধারণা ছিল, কিন্তু সেটা হয়নি। মওসুম শেষে ধান-চালের দাম একধাপ বাড়ে। এবার আমনের মওসুমে কৃষক ধানের ভালো দাম পেলেও বাজারে চালের দাম কমেনি। মওসুম শেষে চালের দাম আরো বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।
অধিক শুল্ক হারের কারণে আমদানি বন্ধ থাকা, বোরো মওসুমে হাওরে বন্যায় ফসলহানি, মজুদে ঘাটতিসহ নানা কারণে কয়েক মাস ধরে ঊর্ধ্বমুখী চালের দাম। এর মধ্যে মোটা চাল প্রতি কেজি ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা, আর সরু চাল ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় ওঠে। এই প্রোপটে গত ১৯ সেপ্টেম্বর চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক ও আমদানির ওপর শুল্ক প্রত্যাহারের পর খুচরায় সরু চাল ৬০ টাকায় এবং মোটা চাল ৪০ টাকায় নামে। নতুন আমন চাল বাজারে এলে দাম আরো কমবে বলে আশার কথা শুনিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। তবে গত ৩০ নভেম্বর সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে আমনের তিন লাখ টন চাল সংগ্রহের ঘোষণা দেয়ার পর মিল গেটেই এখন চালের দাম প্রতি কেজি ৪১ টাকা হয়েছে।
চালকল মালিকেরা বলছেন, সরকার চাল কেনার ঘোষণা দেয়ার আগে নতুন ধানের দাম ছিল মণপ্রতি ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। গত মওসুমেও এই দামে বিক্রি হয়েছিল ধান। এখন ধানের মণ ৯০০ থেকে এক হাজার টাকায় উঠেছে। ধানের কেজি ২৪ টাকা ধরলে কৃষকেরা আমন চাষে লাভজনক পর্যায়ে যাবে। তবে সরকার ৩৯ টাকা করে চালের দাম নির্ধারণের পর ধানের ন্যূনতম বাজার এখন কেজিপ্রতি ২৫ টাকা। গত মওসুমে আমনের দাম ৮০০ টাকা ছিল। এবার হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। উৎপাদন কমে অর্ধেকে নেমেছে। নতুন ওঠা তুলনামূলক সরু জাতের ধানের (স্বর্ণা-পাঁচ) বাজার বাড়তির দিকে। ১৫ দিন আগে এই ধান প্রতি মণ ৮০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে থাকলেও এখন এক হাজার ৫০ টাকা থেকে এক হাজার ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এই ধানের দাম ছিল ৭০০ টাকা।
টিসিবির হিসাবে গত বছরের চেয়ে মোটা চালের দাম এখনো ১২ শতাংশ বেশি। আর চালকল ও ধান-চাল ব্যবসায়ীদের হিসাবে, গত বছরের চেয়ে আমন ধানের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ। গত বছর (২০১৬-১৭) ধানের উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি ১৯ টাকা ও চালে ২৯ টাকা ধরে ৩৩ টাকা কেজি দরে তিন লাখ টন চাল সংগ্রহ করেছিল সরকার। সেখানে চলতি মওসুমে প্রতি কেজি আমন চালের উৎপাদন ব্যয় ৩৭ টাকা ২ পয়সা ধরে প্রতি কেজি চালের দর ৩৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন মিল গেটে মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ৪১ টাকা জানিয়ে চালকল মালিক সমিতির নেতা লায়েক আলী বলেন, এই দাম আর কমবে না, বরং সামনের দিকে আরো বাড়বে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে এখনই চাল আমদানিতে মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। ধানের দাম বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন কম হওয়ার কথা জানিয়ে কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, শেষ বর্ষায় উজান থেকে নেমে আসা ঢলে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বন্যায় আমনের তে ডুবেছে, এর পরও টিকে থাকা ধানে হয়েছে পোকার আক্রমণ। অধিক শুল্ক হারের কারণে আমদানি বন্ধ থাকা, বোরো মওসুমে হাওরে বন্যায় ফসলহানি, মজুদে ঘাটতিসহ নানা কারণে গত কয়েক মাস ধরে (কোরবানির ঈদের পর থেকে) ঊর্ধ্বমুখী চালের দাম।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অটোমেজর হাসকিং রাইসমিল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো: লায়েক আলী বলেন, তার জয়পুরহাট জেলায় ৯২ শতাংশ ধান কাটা শেষ। সেই হিসাবে এখন আমন ধানের ভরপুর বাজার। তবে ধানের দাম গত বছরের চেয়ে প্রতি মণে প্রায় ২০০ টাকা বেশি। দামের এই বৃদ্ধিকে ‘ইতিবাচক’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবার ফলন কম হয়েছে। নওগাঁ জেলায় দুই লাখ ১০০ হেক্টর জমিতে এবার আমন চাষ হয়েছিল। এর মধ্যে বন্যায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। তবে যেটুকু টিকে আছে তাতে ফলন ভালো। এ ছাড়া দেশীয় বাজারে চাহিদা অনুযায়ী চালের জোগানের শঙ্কট রয়েছে। তাই দাম কমার কোনো আশঙ্কা নেই। বরং চলতি মাসের শেষ দিকে আরেক দফা দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানিয়ে বাবুবাজারের চালের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর দেশের চাল উৎপাদনের অবস্থা খুবই খারাপ যাচ্ছে। সরকার যদি থাইল্যান্ড এবং ভারত থেকে চাল আমদানি না করত তাহলে দেশে হয়তো দুর্ভি দেখা দিত। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কৃষি কর্মকর্তা মনজুরুল হুদা জানান, বন্যায় জেলায় ৩৮০০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছিল। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ আবার রোপণও করা হয়েছিল। আবার শেষ মুহূর্তে ভারী বর্ষণের পর কিছু কিছু এলাকায় পোকার আক্রমণও হয়েছিল।
চলতি বছরের শুরু থেকেই দেশীয় বাজারে চালের দরে ঊর্ধ্বগতি। দর বৃদ্ধি পেতে পেতে সব ধরনের চালের দামই এখন ক্রেতাদের প্রায় নাগালের বাইরে। বছরের মাঝামাঝি সরকার দাম কমানোর জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নিলেও সেগুলো খুব বেশি কার্যকর হয়নি। সর্বশেষ চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে চালের। এর ফলে মোটা চালেরই (স্বর্ণা ও পারিজা) দাম কেজিপ্রতি দাঁড়িয়েছে ৪৫ টাকায়। এতে বিপাকে পড়েছেন এই চালের ভোক্তা নি¤œ আয়ের মানুষজন। চালের দরের হঠাৎ উত্থান সম্পর্কে চালের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজার একবার বাড়তির দিকে হলে দাম আর কমে না। সামনের দিনগুলোতে চালের দাম আরো বাড়ার আশঙ্কা বেশি বলে তারা মন্তব্য করেছেন।
সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, পাইকারি বাজারেই কেজিপ্রতি মিনিকেট চাল ৫৬-৫৮ টাকা, নাজিরশাইল ৬৫-৬৭ টাকা, বিআর-২৮ চাল ৪৬-৪৯ টাকা এবং স্বর্ণা ও পারিজা ৪৯ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, কেজিপ্রতি নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। এ ছাড়া মিনিকেটও বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকায়। অথচ গত সপ্তাহে এর দাম ছিল ৬২ টাকা। বিআর-২৮ এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫২ টাকা। স্বর্ণা এবং পারিজা কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪৬ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ৪২-৪৩ টাকা। যদিও আমন ধানের চাল বাজারে এলে চালের দাম কিছুটা কমতে পারে বলে ধারণা করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। বোরো মওসুমের (এপ্রিল-জুন) চাল বাজারে না আসা পর্যন্ত দাম বাড়তি থাকবে বলেও জানান তারা।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি