নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারগুলোকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অন্যতম উৎস্যের জন্য দায়ী করে তা বন্ধের দাবি জানিয়েছে দেশের শিক্ষক সংগঠনগুলো। শিক্ষক সংগঠনগুলোর মতে, কোচিং সেন্টারগুলো শিক্ষার্থী টানতে সংক্ষিপ্ত সাজেশন আকারে প্রশ্ন ফাঁস করছে। প্রশ্ন ফাঁসে শুধু শিক্ষকদের দায়ী না করে বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারগুলোকে বন্ধ করলে প্রশ্ন ফাঁস অনেকাংশে বন্ধ হবে। বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারগুলোকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য দায়ী করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি)।
শিক্ষকরা বলছেন, দেশব্যাপী বাণিজ্যিক কোচিং রমরমা। ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে পরিচালিত সারাদেশে এ ধরনের কত কোচিং সেন্টার আছে সে হিসাব কারো কাছে নেই। রাজধানীর অলিগলি থেকে শুরু করে উপজেলা সদর পর্যন্ত এ ধরনের কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। শিক্ষার্থীদের লোভনীয় অফার দিয়ে কোচিং সেন্টারে টানছে তারা। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেশিরভাগই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। একটি অসাদু চক্র এদের সাথে যুক্ত থাকে যার মাধ্যমেই প্রশ্ন ফাঁস হয়।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক সেলিম উল্লা খন্দকার বলেন, শিক্ষকদের ঢালাওভাবে প্রশ্ন ফাঁসের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। দুর্নীতি দমন কমিশনও কোচিং সেন্টারসহ বিজিপ্রেসে অসাদু কর্মকর্তা কর্মচারীদের দায়ী করছে। আমি মনে করি, সরকার স্কুলে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে যেভাবে নীতিমালা জারি করছে একইভাবে বাণিজ্যিক কোচিং বন্ধের জন্য নীতিমালা থাকা দরকার। এভাবে চলতে পারে না।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির এক গ্রুপের সভাপতি আবুল বাশার হাওলাদার বলেন, সবার আগে স্কুলের বাইরে যে সব কোচিং সেন্টার বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে সেগুলো বন্ধ করা উচিত ছিল। কিন্তু সরকার সেগুলো আগে না করে স্কুলে কোচিং সেন্টার বন্ধ করেছে। শুধু শিক্ষক সমাজ নয়, দুদকও কোচিং সেন্টারগুলোকে দায়ী করছে। তাই যত দ্রুত বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টার বন্ধ করা যায়, ততই দেশের জন্য মঙ্গল হবে।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির অন্য গ্রুপের সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি বলেন, প্রশ্নফাঁসের ক্ষেত্রে কোচিং সেন্টার জড়িত থাকে। তাই বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা কোচিং সেন্টার পুরোপুরি বন্ধের জন্য সরকারের কাছে অনেক আগেই দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু এখনও এসব কোচিং সেন্টার চলছে, যা দুঃখজনক। এগুলো এখনই বন্ধ করার জরুরি।
বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারের মালিকদের সম্পদের খোঁজে রাজধানীর ফার্মগেট, পান্থপথ ও কলাবাগান এলাকায় বুধবার অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) টিম। দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালকের নেতৃত্বে দুদকের সহকারী পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ ও জাহাঙ্গীর আলম অভিযানে অংশ নেন। এ সময় তারা উদ্ভাস, কনফিডেন্ট, রেটিনা, ইউসিসি, সাইফুরস ও ম্যাবসের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিযান চালায়। অবৈধ বাণিজ্যিক কোচিং, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভুয়া পরীক্ষার্থী সরবরাহ ও মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ভর্তি পরীক্ষায় অনিয়মসহ নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদক এ অভিযান চালিয়েছিল। প্রশ্ন ফাঁসের নেপথ্যে কোচিং সেন্টার রয়েছে তারও প্রমাণ পেয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি)। প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে ২০১৫ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিল সংস্থাটি।
প্রতিষ্ঠানটি মনে করে, প্রশ্ন ফাঁস ও বাজারজাত করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত কোচিং সেন্টার। কোচিং সেন্টারগুলো ফাঁসকৃত প্রশ্ন দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন ও বাণিজ্য অব্যাহত রাখার প্রয়াস পায়। কোচিং সেন্টারগুলো সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও মডারেশনকারীদের একাংশের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে নিয়মিত প্রশ্ন ফাঁসে সম্পৃক্ত থাকে।
টিআইবি জানিয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২ অনুসারে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ নীতিমালা লঙ্ঘন করে শিক্ষকদের একাংশ কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। এ ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে অনেকেই কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণে কোনো আইন বা নীতিমালা প্রণীত হয়নি।
অন্যদিকে ‘পাবলিক পরীক্ষাসমূহ (অপরাধ) আইন, ১৯৮০’র ৪ ধারা অনুসারে প্রশ্ন ফাঁসের ন্যায় অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ দশ বছরের কারাদণ্ডের বিধান ছিল। ১৯৯২ সালে আইন সংশোধনের মাধ্যমে এ শাস্তি কমিয়ে চার বছর করা হয়। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সংশোধিত আইনের আওতায় কোনো অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার উদাহরণ দেখা যায় না।
এ বিবেচনায় অবিলম্বে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত সব ধরনের কোচিং সেন্টার বন্ধ করার সুপারিশ করেছিল টিআইবি। কিন্তু টিআইবির ওই সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগই নেয়নি সরকার।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ