মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি সইয়ের দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করার কথা ৷ আর সেই চুক্তি অনুযায়ী ২২ জানুয়ারি থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো শুরু করতে চায় বাংলাদেশ। চুক্তি হয়েছিল গত ২৩ নভেম্বর ৷ খবর ডিডব্লিউ’র। বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্পর্কিত মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি সই হয় গত ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপোদিতে। সেই চুক্তিতে বলা হয়, তিন সপ্তাহের মধ্যে যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন এবং দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া শুরু করবে মিয়ানমার ৷ তবে তারা কত দিনের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শেষ করবে তা বলা হয়নি চুক্তিতে ৷ শুধু বলা হয়েছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফেরত নেয়া হবে।
তিন সপ্তাহের মধ্যে যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করার কথা হলেও তা হয়নি৷ কমিটি’র তালিকা হস্তান্তর হয়েছে মাত্র। তাদের ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ চূড়ান্ত হয়নি ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় আসছেন মিয়ানমারে পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থো ৷ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক এবং মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব বৈঠকে বসে কমিটি এবং টার্মস অব রেফারেন্স চূড়ান্ত করবেন ৷ এ নিয়ে রবিবার বিকালে ঢাকায় পরারাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের সভাপতিত্বে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে ৷ বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের টার্গেট হল চুক্তি অনুযায়ী দুই মাসের মধ্যেই অর্থাৎ ২২ জানুয়ারি থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো শুরু করা ৷ আর যেহেতু বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ‘ফোর্সড রিপ্যাট্রিয়েশন’ এর বিরোধী , এই এই সময়ের আগেই মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা এবং অধিকারের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের খোঁজ রাখছেন কূটনৈতিক প্রতিবেদক শেখ শাহরিয়ার জামান জানিয়েছেন, জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের টার্মস অব রেফারেন্সে অনেক খুঁটিনাটি বিষয় আছে ৷ তবে একটি বিষয় চূড়ান্ত যে, ওয়ার্কিং গ্রুপে দুই দেশ থেকেই সচিব পদমর্যাদার একজন করে কর্মকর্তা নেতৃত্ব দেবে ৷ এছাড়া এই কমিটি কোথায় যাবে, কোন সীমান্ত দিয়ে যাবে, কতদিনে তাদের কাজ শেষ হবে এসব কিছু চূড়ান্ত হবে৷ তবে বাংলাদেশ জোর দিচ্ছে নির্ধারিত দুই মাসের মধ্যেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে ৷
বর্তমানে মিয়ানমার নামে পরিচিত দেশে ১২ শতক থেকে মুসলমানরা বাস করছে বলে দাবি অনেক ইতিহাসবিদ ও রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর ৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন বলছে, মিয়ানমার যখন ব্রিটিশ শাসনের অধীন (১৮২৪-১৯৪৮) ছিল তখন বর্তমানের ভারত ও বাংলাদেশ থেকে অনেকে শ্রমিক হিসেবে সেখানে গিয়েছিল৷ তবে তারা যেহেতু ব্রিটিশ আমলে এসেছে তাই স্বাধীনতার পর মিয়ানমার তাদের অবৈধ হিসেবে গণ্য করে৷ এদিকে অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এক্সচেঞ্জের জরিপ থেকে জানা গেছে, রাখাইনে পরিস্থিতির উন্নতি হলে ৭৮ শতাংশ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়৷ শতকরা ১৬ ভাগ রোহিঙ্গা ফেরত যাওয়ার বিপক্ষে৷ আর শতকরা ৬ ভাগ রোহিঙ্গা কোনো শর্ত ছাড়াই মিয়ানমারে ফেরত যেতে চায়৷ মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক ডিফেন্স এটাশে মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশের মত মিয়ানমারও দ্রুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় ৷ দু’দিন আগে মিয়ানমারে এক মন্ত্রীও একথা বলেছেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোথায় রাখা হবে? তাদের ঘরবাড়িতো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ ১২টি আন্তর্জাতিক এনজিও বলেছে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে তারা নেই৷ তারা চুক্তি রিভাইস করার কথা বলছে৷ তারা এখানে অর্থ দেবে না। তাহলে টাকা আসবে কোথা থেকে? আর সেখানে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা কে দেবে?’
গত ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছে ১৯৯২ সালের চুক্তির আলোকে৷ ১৯৯২ সালের চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিক মর্যাদা দেয়ার বিষয়টি নেই। ওই চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের স্থায়ী অধিবাসী হিসেবে সেখানকার সমাজে অন্তর্ভুক্তির কথা ছিল৷ রোহিঙ্গাদের অধিকারসহ মিয়ানমারের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মৌলিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের উল্লেখ ছিল না৷ সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, মিয়ানমার ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবরের পর ও এ বছরের ২৫ আগস্টের পরে যারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে তাদের ফেরত নেবে৷ এই শর্ত মানা হলে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা ফেরত নেয়া উচিত৷ কিন্তু বাংলাদেশে এখন রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে সাড়ে ১০ লাখ৷ ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ছয় লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে মিয়ানমার থেকে৷
২০১৬ সালের আগে আসা তিন লাখ রোহিঙ্গা ফেরত নেয়ার কথা চুক্তিতে নেই৷ এবারের চুক্তিতে ফেরত নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রথমে অস্থায়ী পুনর্বাসন ক্যাম্পে রাখার কথা বলা হয়েছে৷ এরপর তাদের ফেলে আসা ঘড়বাড়ি বা অন্যকোথাও পুনর্বাসন করা হবে৷ কিন্তু নাগরিকত্বের বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি৷ ১৯৯২ সালে দু’দেশের মধ্যে যে সমঝোতা হয় তার অধীনে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে মাত্র দুই লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নেয় মিয়ানমার৷ তবে ১৯৭৮ সালে যে চুক্তি হয়েছিল, তার অধীনে ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিয়েছিল মিয়ানমার৷ –ডয়েচে ভেলে
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি