নিজস্ব প্রতিবেদক:
‘মাদারীপুর টেক্সটাইল এন্ড স্পিনিং মিলস’টির ৮ কোটি টাকার সম্পত্তির বিপরীতে ৬১৮ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক। এই ঋণ প্রদানে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও ব্যাংকটির কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, সরকারের অনুমতিতে ওই ঋণ দেওয়া হয়েছে। তবে সরকারের পাট ও প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বলেন, ঋণ দেওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ ব্যাংকের বিষয়।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ‘মাদারীপুর টেক্সটাইল এন্ড স্পিনিং মিলস’টি ১৯৯৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিরাষ্ট্রীকরণ করা হয়। এরপর ৮ কোটি ৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা দিয়ে মিলটি ক্রয় করেন মাদারীপুরের জনৈক ব্যবসায়ী ইউসুফ বাবু। মিলটি মর্গেজ রেখে ১৯৯৬ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে শুরু করে মাত্র কয়েক বছরে ৬১৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ঋণ দেয় রূপালী ব্যাংক, লোকাল শাখা।
ঋণ গ্রহণের পর মাদারীপুর টেক্সটাইল এন্ড স্পিনিং মিল কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ মেয়াদী ঋণের কিস্তির এক টাকাও পরিশোধ করেনি। ফলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় চলতি বছরের ১৩ জুলাই মিলটির যাবতীয় শেয়ার, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও স্বত্ব সরকার পুন:গ্রহণ বা টেকব্যাক করে।
পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত মিলটি ব্যবস্থাপনার নিমিত্তে এ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা বিটিএমসির নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত করে সরকার। ফলে মিলটি মর্গেজ নিয়ে বড় অঙ্কের ঋণ প্রদান করায় বিপাকে পড়েছে ব্যাংকটি।
বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে লোকাল ব্রাঞ্চের দেওয়া ৬১৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ঋণ আদায়ে তৈরি হয়েছে বড় ধরনের অনিশ্চিয়তা।
বিষয়টি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ব্যাংকটির খোদ ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো: আতাউর রহমান প্রধান। তিনি বলেন, সরকার টেকব্যাক করে চিঠি দিয়েছে। আমরা জবাবও দিয়েছি।
তিনি বলেন, ঋণ গ্রহীতা অসুস্থ ছিলেন। তিনি (ইউসুফ বাবু) চিকিৎসা শেষে দেশে এসে মিলটি ফিরে পেতে উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন। সরকার ও মিলের মালিকের মধ্যে বিষয়টি নিস্পত্তির জন্য তিন মাসের সময় দিয়েছে আদালত।
তিনি বলেন, আমরা ঋণের টাকা পেতে আশাবাদী, কারণ সরকার অনুমতি দিয়েছে লোন দিতে। তবে লোনের মেয়াদ অনেক বেশি এবং অলরেডি তা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে ফলে লোন আদায়ের বিষয়টি নিয়ে অবিয়েসলি আমি ঝুঁকি ফিল করছি।
ব্যাংকটির লোকাল ব্রাঞ্চের এজিএম মো. সারোয়ার হোসেন বলেন, মিলটি যেহেতু বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় টেকব্যাক করেছে সেক্ষেত্রে ঋণ আদায়ের বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই ব্যাংক ঝুঁকির মধ্যে আছে।
সরকারি একটি মিল গ্রহণের পর মূল্য পরিশোধের আগেই একজন ব্যবসায়ীকে এত বড় অংকের ঋণ প্রদান করা হল কিভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যাংকটির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো. আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ‘দেখুন আমরা যখন কোনো প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ঋণ প্রদান করি তখন সাধারণত সেই প্রতিষ্ঠানের দেড়গুণ পরিমাণ সম্পদ মর্গেজ রাখি। এখন যেহেতু সরকার মিলটি টেকব্যাক করেছে ঋণ গ্রহীতা মামলাও করেছে, সেখানে আদালত বিষয়টি চূড়ান্ত করবেন।
যদি দেড়গুণ সম্পতি গ্রহণ করে ঋণ প্রদান করা হয় তাহলে মাত্র ৮ কোটি টাকার বিপরীতে ৬১৮ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করা হল কিভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো সন্তোষজনক উত্তর মেলেনি ব্যাংকটির এ কর্মকর্তার কাছ থেকে।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের বেসরকারিকরণ ও বিরাষ্ট্রীয়করণ শাখা সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে যখন মিলটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। তখন মিলের মূল্য ধরা হয়েছিল মাত্র ৮ কোটি ৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা। কিন্তু মিলটির অনুকূলে রূপালী ব্যাংক লোকাল অফিস শাখা ৬১৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা লোন প্রদান করে। স্বল্প মূল্যের সম্পদের মর্গেজে এত বড় অংকের ঋণ কিভাবে দেয় তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে মন্ত্রণালয়ের এ সূত্রটিও।
ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, মিলটি মর্গেজ দেখিয়ে ৬১৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণের পর থেকেই ঋণ সংক্রান্ত শর্ত অমান্য করে তা পরিশোধের কোনো চেষ্টাই করছেন না ইউসুফ বাবু নামের ওই ব্যবসায়ী।
রূপালী ব্যাংক হেড অফিস শাখার এজিএম মো. সারোয়ার হোসেন বলেন, মিল মালিক ইউসুফ বাবু ঋণ নিয়মিত পরিশোধ না করায় আমরা ঋণটি ক্লাসিফাইড (আদায় না হলে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রথম ধাপ) করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। বাধ্য হয়েই আমরা তার বিরুদ্ধে মামলা করব।
এ পর্যন্ত কোনো আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এ কর্মকর্তা বলেন, ঋণ গ্রহীতা ক্লাসিফাইড না হওয়া পর্যন্ত কোনো আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ নেই। সপ্তাহখানেক আগে ব্যাংক পরিচালনা পরিষদ তাকে ডেকে নিয়ে কথা বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকের সকল কর্তাব্যক্তিরা অবহিত।
এ ব্যাপারে ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ইয়াসমিন বেগম বলেন, আমরা যে সম্পত্তির বিপরীতে ঋণ প্রদান করেছি ওই সম্পত্তি যেহেতু সরকার টেকব্যাক করেছে এ ঋণের চূড়ান্ত ফয়সালা সরকারই করবে।
লিজ গ্রহণ করা সরকারি মিলের মর্গেজ গ্রহণ করে এত বড় অংকের টাকা ঋণ কিভাবে প্রদান করেছেন তা আদৌ কতটুকু ন্যায়সঙ্গত হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে রূপালী ব্যাংকের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো. আতাউর রহমান প্রধান বলেন, দেখুন যখন ঋণ প্রদান নিশ্চয়ই উপযুক্ত কাগজপত্র নিয়েই করা হয়েছে। গভমেন্টের পারমিশন আছে বলেই ঋণ প্রদান করা হয়েছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, সরকারি এ মিলটির দাম যদি মাত্র ৮ কোটি ৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা হয় তাহলে উক্ত মিলের বিপরীতে ৬১৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয় কিভাবে তা কারও কাছে পরিস্কার নয়।
টেকব্যাকে লম্বা সময় নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রীনা পারভীন বলেন, দেখুন বেসরকারি খাতকে শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে দেশের জাতীয় উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে মিলটি প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের মাধ্যমে বিক্রয় করা হয়। সেজন্য আমরা হাজার হাজার শ্রমিক কর্চারীদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের বিষয়টি বিবেচনা করেই টেকব্যাক করতে বেশি সময় নিয়েছি।
মিলটির সমুদয় পাওনা প্রাপ্তিতে কি ধরনের পদক্ষেপ ছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে সরকারি এ কর্মকর্তা বলেন, আমরা ২০০৯ সালের এপ্রিল ও জুন, ২০১১ সালের জুলাই, ২০১৩ সালের এপ্রিল এবং ২০১৪ সালের মার্চ মাসে মিল গ্রহীতা ইউসুফ বাবুকে তাগিদপত্র ও চূড়ান্ত নোটিশ প্রদান করেছি। তা সত্ত্বেও ক্রেতা সরকারি পাওনা পরিশোধ করেনি। এজন্যই দেরিতে হলেও মিলটি টেকব্যাক করেছে সরকার।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে পাট ও প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এমপি বলেন, ঋণ দেওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ ব্যাংকের বিষয়। এ নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।
মিলের ক্রয় মূল্য পরিশোধের জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কি ধরনের আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, টাকা না দেওয়ায় আমরা মিলটি টেকব্যাক করেছি।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ