২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৭:২৫

ইথিফনে পাকছে অপরিণত টমেটো

নিজস্ব প্রতিবেদক:

জমি থেকে তোলা হচ্ছে কাঁচা টমেটো। তারপর সে টমেটোয় স্প্রে করা হচ্ছে ‘ইথিফন’ গ্রুপের এক ধরনের কেমিকেল। এতেই সবুজ টমেটো হয়ে উঠছে লাল টুকটুকে। জমি থেকে কাঁচা তোলা হলেও সে টমেটো আর কাঁচা থাকে না। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মাঠ থেকে পাকা হিসেবেই বিক্রি হচ্ছে সেসব টমেটো।

কৃষি বিভাগ বলছে, ইথিফন ক্ষতিকর নয়। তবে কেমিকেলটির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অন্যদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইথিফন ব্যবহারের ফলে টমেটোর পুষ্টিগুণ লোপ পায়। এছাড়া অ্যাসিডিটিসহ বিভিন্ন বিপাক-সংক্রান্ত রোগ এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়ে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, অপরিণত কাঁচা টমেটো পাকাতে শুধু ইথিফনই ব্যবহার করা হচ্ছে না, পঁচন রোধে ব্যবহার করা হচ্ছে ডায়াথিন গ্রুপের কেমিকেলও। আবার চকচকে আকর্ষণীয় করতে ব্যবহার হচ্ছে শ্যাম্পু। রোদে শুকাতে দিয়ে ইথিফনের মতো ডায়াথিন এবং শ্যাম্পুও স্প্রে করা হচ্ছে টমেটোতে। কৃষকরা বলছেন, ভালো দাম পাওয়ার আশায় এসব স্প্রে করছেন তারা।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তৌফিকুর রহমান বলেন, নির্দিষ্ট একটা মাত্রায় ইথিফন ব্যবহার করা যায়। তবে টমেটো গাছে থাকা অবস্থায় এটা ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু টমেটো তোলার পর তাতে শ্যাম্পু কিংবা ডায়াথিন ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। এটা অন্যায়। কেউ এ ধরনের কাজ করে থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কৃষি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০১১ সালে তারা গোদাগাড়ীর ইথিফন মিশ্রিত টমেটো কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। সেখান থেকে যে প্রতিবেদন এসেছে, তাতে ওই মাত্রার ইথিফন ব্যবহারকে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলা হয়নি। তাই ইথিফন ব্যবহারের বিরুদ্ধে তারা অভিযান চালান না।

তবে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দ্রুত টমেটো পাকাতে মাত্রাতিরিক্ত ইথিফন ব্যবহার করছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা। এ কাজে এখন পর্যন্ত ব্যবসায়ীরাই বেশি জড়িত। অধিকাংশ কৃষকই এখন কাঁচা টমেটো বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীদের কাছে। আর ব্যবসায়ীরা সেসব টমেটো কৃত্রিম উপায়ে পাকিয়ে পাঠাচ্ছেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।

নাটোর থেকে গোদাগাড়ীতে আসা টমেটো ব্যবসায়ী আবদুস সালাম বলেন, কাঁচা টমেটো রোদে শুকাতে দিয়ে মেশিনের সাহায্যে ইথিফন ও ডায়াথিন স্প্রে করা হয়। সন্ধ্যায় সেগুলো খড় ও পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। পরদিন আবার শুকাতে দেয়া হয় রোদে। তখন দুইএকবার স্প্রে করা হয় কেমিকেল। এভাবে দুই-তিন দিন ঢেকে রাখার পর আবার রোদে শুকালেই লাল হয়ে ওঠে টমেটো।

উপজেলার সাহাব্দিপুর এলাকার কৃষক আবদুল কাদেরও ইথিফন দিয়ে টমেটো পাকাচ্ছেন। তিনি বলেন, শীতের কারণে টমেটো পাকতে দেরি হয়। আবার গাছে পাকলেও সেগুলো পাখি খেয়ে ফেলে। তাই কাঁচা টমেটো জমি থেকে তুলে এনে তাতে ইথিফন স্প্রে করে পাকানো হয়।

কাদের বলেন, স্প্রে না করলে টমেটো ১৫ দিনেও পাকবে না। বাড়িতে থেকে থেকেই পঁচে যাবে। এ কারণে কেমিকেল স্প্রে করে দ্রুত পাকাতে হয়। আর টমেটো খুবই পঁচনশীল। তাই পঁচনরোধেও স্প্রে করা হয় ডায়াথিন। পাশাপাশি চকচকে করতে স্প্রে করা হয় শ্যাম্পু। এতে টমেটো লাল টুকটুকে হয়। ফলে দাম পাওয়া যায় ভালো।

জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. প্রদীপ কুমার বিশ্বাস বলেন, মানবদেহে ইথিফনের বিষক্রিয়া তাৎক্ষণিক বোঝা যায় না। তবে ইথিফন মিশ্রিত ফল খেলে কিডনি বিকল এবং ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ছত্রাকনাশক ডায়াথিনে স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বেশি। এসব কেমিকেল মিশ্রিত ফল না খাওয়ার জন্য তারা সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাবেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তৌফিকুর রহমান জানান, দেশে সবচেয়ে বেশি শীতকালীন টমেটো চাষ হয় গোদাগাড়ীতে। এ বছর এখানে টমেটো চাষ হয়েছে দুই হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে। প্রতি হেক্টর জমি থেকে আনুমানিক ৩০ মেট্রিক টন করে টমেটো পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই হিসাবে এবার টমেটোর উৎপাদন হবে প্রায় ৭৮ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, এবার নকল টমেটো বীজে প্রতারিত হয়েছেন অনেক কৃষক। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৩০ হেক্টর জমির টমেটো। সেসব জমি থেকে ইদানিং সামান্য পরিমাণে টমেটো উঠছে। এখন কেমিকেল ব্যবহারের মাধ্যমে গোদাগাড়ীতে উৎপাদিত সব টমেটোই পাকানো হচ্ছে কৃত্রিম উপায়ে।

তারা বলছেন, কোনো কৃষকই গাছে স্বাভাবিকভাবে পাকতে দিচ্ছেন না টমেটো। কৃত্রিম উপায়ে পাকানো টমেটো এখন দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ এবং কাঁচা এক হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।

দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ

প্রকাশ :ডিসেম্বর ৫, ২০১৭ ১২:১৫ অপরাহ্ণ