নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েই রক্ষক থেকে ভক্ষকের ভূমিকায় চলে যান আবদুল হাই বাচ্চু। মূলত তার নেতৃত্বেই চলে ব্যাংকের ভেতর-বাইরে ভয়াবহ লুটপাট।লুটপাটে সুবিধার জন্য কোনো নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করেই তার একক সিদ্ধান্তে চালাতে থাকেন ব্যাংকটি। ভুয়া নাম ঠিকানায় দিতে থাকেন কোটি কোটি টাকা ঋণ। ফলে মাত্র চার বছরের মাথায় বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৪১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকাতে।
শুধু ঋল জালিয়াতিই নয়, বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও তার একক আধিপত্য চলতে থাকে। অবশেষে এক সময়ের এ দাপুটে লুটেরা ব্যাংকার সোমবার মুখোমুখি হলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। এর আগে বাচ্চুর অনিয়ম ও লুটপাট নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে চাপের মুখে ২০১৪ সালের ৪ জুলাই বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। দুদকও বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত শুরু করে। সেই সঙ্গে দুদকের তদেন্ত বেরিয়ে আসতে থাকে ভয়াবহ এ লুটপাটের আসল চিত্র।
অর্থ লুটপাটের অভিযোগে একের পর এক মামলা করতে থাকে দুদক। এ অবস্থায় রহস্যজনকভাবে দুদকের তদন্ত চলার সময়েই পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন বাচ্চু। দুদক একের পর এক মামলা করলেও অদৃশ্য ক্ষমতার জোরে লুটপাটের অভিযোগ থেকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যান বাচ্চু। দুদক একে একে ৫৬টি মামলা করলেও কোনোটিতেই লুটপাটের অভিযোগে বাচ্চুর নাম আসেনি। দুদক সবগুলো অভিযোগ থেকেই বাচ্চুকে দূরে রাখে। এ অবস্থায় বিভিন্ন মহলের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে দুদক।
অভিযোগ উঠে, সরকারের আর্শিবাদপুষ্ট হওয়ায় দুদক বাচ্চুকে দায়মুক্তি দিয়েছে। এরপরই বেসিক ব্যাংক ইস্যুতে দুদকের কাজে কট্টর সমালোচনা করে অসন্তোষ প্রকাশ করে উচ্চ আদালত। গত ২৬ জুলাই আবদুল হাই বাচ্চুসহ ব্যাংকটির তত্কালীন পর্ষদের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। আদেশপ্রাপ্তির ৬০ দিনের মধ্যে মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে আদালতে প্রতিবেদন দিতেও নির্দেশ দেন আদালত।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই নড়েচড়ে বসে দুদক। আবদুল হাই বাচ্চুসহ তত্কালীন পর্ষদ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দুদক। যার ফলশ্রুতিতে সোমবার দুদকে আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এদিকে অর্থমন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনেও বেসিক ব্যাংকের লুটপাটে আব্দুল হাই বাচ্চুর সম্পৃক্ততা উঠে আসে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বাচ্চুর সম্পৃক্ততার বিষয়টি সরাসরি জানিয়ে দেন। গত ২৯ শে মার্চ অর্থমন্ত্রী বলেন বাচ্চুকে দায়ী করে দেওয়া রিপোর্ট দুদকের কাছে দেওয়া হয়েছে। ইনভেস্টিগেশনে- হি হ্যাজ বিন ব্লেম ইন ঋণ কেলেঙ্কারি।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, সিজিএ কার্যালয় ও খোদ বেসিক ব্যাংকের নানা প্রতিবেদনে এ লুটপাটের সঙ্গে বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এমনকি বিভিন্ন সময়ে শুনানিতে এ বিষয়ে আদালতেরনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে দুদককে। মূলত এসব চাপেই দুদক থেকে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের বিষয়ে এ জিজ্ঞাসাবাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে ২০১৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর তিন দিনে টানা ৫৬টি মামলা করে দুদকের অনুসন্ধান দলের সদস্যরা। রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন ও গুলশান থানায় এসব মামলায় মোট আসামি করা হয় ১৫৬জনকে। মামলায় ২ হাজার ৬৫ কোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে রাজধানীর গুলশান শাখার মাধ্যমে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, শান্তিনগর শাখা থেকে ৩৮৭ কোটি টাকা, প্রধান শাখা থেকে প্রায়২৪৮ কোটি টাকা এবং দিলকুশা শাখা থেকে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়।
ভয়াবহ এ ঋণ জালিয়াতির মামলায় আসামিদের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তা রযেছেন ২৬ জন। বাকি ১৩০ জন আসামি ঋণ গ্রহীতা ৫৪ প্রতিষ্ঠানের স্বত্ত্বাধিকারী ও সার্ভে প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকার ও ঋণ গ্রহীতাদের অনেকেই একাধিক মামলায় আসামি হয়েছেন। এর মধ্যে ব্যাংকের প্রাক্তন এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে ৪৮টি মামলায়। এ ছাড়া সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া ডিএমডি ফজলুস সোবহান ৪৭টি, কনক কুমার পুরকায়স্থ ২৩টি, মো. সেলিম ৮টি, বরখাস্ত হওয়া ডিএমডি এ মোনায়েম খানকে ৩৫টি মামলায় আসামি করা হয়। তবে কোনো মামলায় ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে আসামি করা হয়নি।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ
Daily Deshjanata দেশ ও জনতার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর

