নিজস্ব প্রতিবেদক:
মন্দঋণের কবলে পড়ে গেছে দেশের ব্যাংকিং খাত। সাধারণের আমানতের অর্থ ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু সেই ঋণকাঙ্খিতহারে আদায় হচ্ছে না। ফলে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। আবার খেলাপি ঋণ আদায়ের হারও অনেক কম। বেশির ভাগ খেলাপি ঋণ আদায় অযোগ্য বা কুঋণে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত মার্চ প্রান্তিকে আদায় অযোগ্য ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে মোট খেলাপি ঋণের ৮২ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোরই প্রায় ৮৪ শতাংশ। আদায় অযোগ্য ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর সম্পদের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতাও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ছয়টি সরকারি ব্যাংকের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৩৫ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দঋণই ২৯ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ৩৯টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দঋণই ২৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের ৮০ দশমিক ১৬ শতাংশ। শতকরা হারে সবচেয়ে বেশি মন্দঋণ ৯টি বিদেশী ব্যাংকের। ব্যাংকগুলোর মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দঋণই ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা, যা তাদের মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৯৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। কুঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণের কিস্তি পরপর তিন মাস আদায় না হলে ওই ঋণকেনিম্ন মানের ঋণ বলা হয়। আবার কোনো ঋণ পরপর ৬ মাস আদায় না হলে তা সন্দেহজনক ঋণ বলা হয়। সন্দেহজনক ঋণ হলেই গ্রাহকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। আবার ওই ঋণ ৯ মাস অতিক্রান্ত হলে তা মন্দঋণে পরিণত হয়। এ মন্দঋণ হলেই টাকা আদায়ের জন্য মামলাসহ সকল প্রকার পদক্ষেপ নিতে হয়। সোনালী ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘ দিন মামলার ঘানি টানতে হচ্ছে। কিন্তু মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এ দিকে নতুন করে আবার খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে বাড়ছে মন্দঋণ ও মামলার জট। ব্যাংকও মামলা পরিচালনা করতে অর্থ ব্যয় করে। এভাবে কোনো ঋণ ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে ওই ঋণ খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে আলাদা করে থাকে ব্যাংক, যা ব্যাংকের ভাষায় ঋণ অবলোপন বলা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব ঋণ আদায় হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের দুর্নীতিসহ নানা অনিয়ম বেড়ে গেছে।
সামাজিক দায়বদ্ধতার নামে অর্থ ব্যয়, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ বিতরণ, লোকবল নিয়োগ করে ব্যাংকের ব্যয় বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে আদায় অযোগ্য ঋণ আরো বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর ঝুঁকির হার আরো বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেই মন্দঋণের পরিমাণ বেশি ছিল। সেই তুলনায় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে কম ছিল। কিন্তু এখন সরকারি ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও মন্দঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।
অর্থাৎ যে ঋণ একবার খেলাপি হচ্ছে ওই ঋণ আর সহজেই আদায় হচ্ছে না। ফলে তাদের মন্দঋণ বা আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।
ব্যাংকগুলোর মন্দঋণ বেড়ে যাওয়ায় আয় কমে যাচ্ছে। কারণ মন্দঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকগুলোর আয় খাতের অর্থ থেকে। একই সাথে কমে যাচ্ছে বিনিয়োগ সক্ষমতা। কারণ, আমানতের অর্থঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়।
কম হারে আমানত নিয়ে বেশি মুনাফায় ঋণ বিতরণ করা হয়। ঋণ আদায় না হলেও শর্ত অনুযায়ী নির্ধারিত মেয়াদ শেষে সুদে আসলে আমানতকারীদের পরিশোধ করতে হয়।
এভাবে এখন অনেক ক্ষেত্রেই ঋণ আদায় না হওয়ায় নতুন আমানতের অর্থ থেকে মেয়াদপূর্তির আমানত পরিশোধ করতে হচ্ছে। যেখানে ঋণ আদায় হলে ব্যাংকগুলো বেশি হারে বিনিয়োগ করতে পারতো। এভাবেই ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সেই সাথে বাড়ছে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত মুনাফা। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনে ব্যাংকগুলোকে কঠিন মূল্য দিতে হবে।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ