নিজস্ব প্রতিবেদক:
অধঃস্তন আদালত ব্যবস্থায় সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। এর ফলে স্বচ্ছতার ঘাটতি, প্রতারণা ও জালিয়াতি, দায়িত্ব পালনে অবহেলা, ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেন এবং নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে অনিয়ম হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে অধঃস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান এককভাবে সুপ্রিম কোর্টের উপর ন্যস্ত করার সুপারিশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ‘বাংলাদেশের অধঃস্তন আদালত ব্যবস্থা, সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব গবেষণার ফল থেকে এসব তথ্য উঠে এসেছে বলে জানানো হয়েছে।
রাজধানীর ধানমন্ডির ২৭ নম্বরে অবস্থিত মাইডাস সেন্টারে আজ বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলন টিআইবির পক্ষ থেকে এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাম্মী লায়লা ইসলাম, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা এসব তথ্য জানান। গবেষণাপত্র থেকে জানানো হয়, কিছু ক্ষেত্রে বিচারকদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি প্রক্রিয়া দীর্ঘ, কর্মচারী পদে, পদ অনুযায়ী দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয় না। বদলি না হওয়ায় কর্মচারীরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। কর্মচারীদের পদোন্নতির সুযোগ কম। অনেক ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীরা দালাল এবং লাইসেন্স বিহীন আইনজীবীর মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছেন। আইনজীবী ও তাদের সহকারীদের ফি’র বাইরে মক্কেলদের কাছ থেকে বেশি অর্থ আদায় করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই আদালতের কর্মচারীরা ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ ছাড়া কাজ করেন না। এক্ষেত্রে সাক্ষীর শুনানি, স্বাক্ষর করা, জেরার সময় যথাযথ ভূমিকা না রাখা, মামলা আপোস বা প্রত্যাহারে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ৬ লাখ পর্যন্ত ঘুষ আদায় করেন। মামলার বিভিন্ন কাজে কোর্ট পুলিশ ২০০ থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেন। রায় বা আদেশ প্রভাবিত করার জন্য ২০ হাজার থেকে শুরু করে ১০ লাখ টাকা লেনদেন হয়।
যেমন দেওয়ানি মামলায় আরজি দাখিলে ২০ থেকে ২ হাজার টাকা, শুনানির পরবর্তী তারিখ নির্ধারণে ১০০ থেকে এক হাজার টাকা, সমন জারিতে ২০০ থেকে ১০ হাজার টাকা, ফলিওর উপর নির্ভর করে রায়ের নকল বা জাবেদা নকল উত্তোলনে ২০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা, নথি দেখার জন্য ৫০ থেকে ৫০০ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়। ফৌজদারি মামলায় বিবাদির পিটিশন দাখিলে ৫০ থেকে ৩০০ টাকা, মামলার ফাইলিং করতে ২০ থেকে ৩০০ টাকা, কোনো নথির কপি তুলতে ৫০ থেকে ১০০০ টাকা, ফলিওর উপর নির্ভর করে জাবেদা নকল তুলতে ৫০০ থেকে ৫ হাজার, জামিননামা জমা দিতে ১০০ থেকে ১৫০০ টাকা, জামিননামা ও জামিনের আদেশ কারাগারে প্রেরণ করতে ১০০ থেকে ৫ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়া হয়।
গবেষণা থেকে এসবের কারণ হিসেবে জানানো হয়- দ্বৈত প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা; আইনি অবকাঠামো, লজিস্টিক, বাজেট, জনবল ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি; কার্যকর জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও তথ্যের উন্মুক্ত ঘাটতি, মামলার পদ্ধতিগত জটিলতা। এর ফলে সুপ্রিমকোর্ট এবং মন্ত্রণালয়ের দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়েন সৃষ্টি, বিচারিক কার্যক্রম ও আদালতের প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া, বিচারকের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। এর প্রভাবে বিচার প্রার্থীদের ন্যায়বিচারে অভিগম্যতা ব্যাহত হচ্ছে, বিচারপ্রার্থীরা আর্থিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হছেন, বিচারপ্রার্থীদের আদালতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভীতি সৃষ্টি ও ন্যায়বিচার ব্যাহত হচ্ছে। টিআইবি আরও জানায়, দেশের মোট ১৮টি জেলা থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। যা ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়।
তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, অধঃস্তন আদালতের বিভিন্ন পর্যায়ের বিচারক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী, আইনজীবীর সহকারী/মুহুরি, এনজিও প্রতিনিধি, সাংবাদিক, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল এবং টিআইবির বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা। এ সময় সুলতানা কামাল এবং টিআইবির ড. ইফতেখারুজ্জামান সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি