এক
মনটা আজ খুব বেশী ভালো নেই রাতুলের। রমজানের ছুটি পড়তে আর মাত্র দু’দিন বাকি। রাতুলের আব্বু-আম্মু সবাই ভাবছে ছুটি পড়লেই তাদের একমাত্র আদরের ছেলেটা চোখের সামনে এসে হাজির হবে। বাস্তবিক প্রয়োজনে হাতছাড়া হওয়া ছেলেটা চোখের সামনে আসলেই তাদের (পিতৃ-মাতৃ) ¯েœহের অপুর্ণতা রাখবেনা। কিন্তু দুর্ভোগ্য! রমজানের ছুটি পড়ার সাথে সাথেই রাতুল গ্রামের বাড়িতে তার আব্বু-আম্মুর কাছে যেতে পারছেনা। সন্ধ্যায় যখন রাতুল তার মাকে ফোন করে বললো,আম্মু আমার হয়তো বাড়ি ফিরতে রোজা পনের-বিশটা হয়ে যাবে, তুমি কিছু মনে নিও না। রাতুল দেখলো, তার মা এতক্ষণে যে কণ্ঠ দিয়ে হাসি মুখে তার সাথে কথা বলছিল, সেটা একটু ছোট হয়ে আসল। কিছুদিন আগে রোজার প্রথমে ক্যাম্পাস বন্ধের সাথে সাথে রাতুল বাড়ি যেতে চাইলেও এখন কেন রোজা পনের-বিশটা হলে বাড়িতে যাবে এ নিয়ে তার মা তাকে একটা প্রশ্নও করলো না। শুধুমাত্র একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস নিয়ে বললো, তুই যেটা ভালো বুঝিস সেটা কর।
এখন যদি রাতুল বাড়িতে যায় তাহলে তার ক্লাস লেকচার নোট করা হবে না। আর ঈদের পরপরই তার সেমিষ্টার ফাইনাল শুরু। এজন্য তার বাবা-মা যতই কষ্ট পাক না কেন, ছুটির প্রথম দিকে ক্যাম্পাসে কিছুদিন থেকে তারপরে তাকে বাড়ি যেতে হবে।
মায়ের সাথে কথা বলা শেষে ফোনটা রেখে দিয়ে রাতুল যখন মন খারাপের সাথে বসে আছে, ঠিক তখনই তার মোবাইলে একটা মেসেজ এসে টুং টুং করে বেজে উঠল। মোবাইল হাতে নিয়ে সে ইনবক্স চেক করে দেখল, অপরিচিত কেউ নন,চিরচেনা মানুষটিই তাকে মেসেজে লিখছে, কেমন আছেন?
মেয়েটির মেসেজের উত্তরে রাতুল লিখল, খুবই ভালো, তুমি?
খুব বেশী ভালো না।
কেন?
কেন আর শুনতে হবে না । শুনলে তোমার রাগ হবে।
কথাটা শুনে রাতুল ইতস্তত করতে লাগল। সে ভাবল, এমন কি বিষয় যার জন্য আমার প্রিয়তমা ভালো নেই! একটু সময় নিয়ে তারপরে সে মেয়েটিকে বললো, কথা দিচ্ছি,আমি রাগ করবো না।এবার বল, তুমি কেন ভালো নেই?
কিছুক্ষণ পরে রাতুলের মোবাইলে একটা মেসেজ আসল,আসলেই না আমার মনে হয়, মেয়ে হিসেবে এ সমাজে জন্ম নেওয়াটাই পাপ!
কোন কথার কোন উত্তর! রিপ্লাই মেসেজ দিয়ে রাতুল তাকে বললো,প্লিজ স্পষ্ট করে বলো না,তুমি কি বলতে চাচ্ছো।
অনেকটা হতাশার সাথে মেয়েটি বললো,কি আর বলবো বলো! তোমাদের ছেলেদেরতো তো আর কোন কাজের জন্য কাউকে হিশেব দিতে হয় না। অথচ আমাদের মেয়েদের প্রত্যেকটা পদে পদে স্বামী,শাশুড়ি,শ্বশুর,বাবা সবাইকে হিশেব দিয়ে পা ফেলতে হয়। আর সেখানে মানুষ হিশেবে একটু ভুল হলেই আমি ব্যার্থ!
এবার একটু অভিমান হলো রাতুলের। সে শুনতে চেয়েছে মেয়েটির ভালো না থাকার কারণ, আর মেয়েটি না তাকে শুনাচ্ছে অন্যকিছু। খানিকটা অভিমানের সাথেই সে মেয়েটিকে বললো,প্লিজ বলোনা তুমি কেন ভালো নেই?
হয়তো অনেক কষ্ট হচ্ছিল। এজন্য একটু দেরি নিয়ে মেয়েটি বললো, আমার হয়তো খুলনায় কোচিং করা হবে না! ঢাকায় যেতে হবে!
অনেকটা ভড়কে গেল রাতুল।প্রায় তিন মাস পরে বাড়িতে গিয়েও তার মনের মানুষটির সাথে দেখা হবে না! আর তাছাড়া ঢাকায় গেলে মেয়েটি কুরবানি ঈদে গ্রামের বাড়িতে ফিরতে পারবে না।অর্থাৎ রোজার ছুটিতে রাতুল যদি মেয়েটির সাথে দেখা করতে না পারে তাহলে তাকে প্রায় পাঁচ মাস অপেক্ষা করতে হবে তাকে এক নজর দেখার জন্য। কথাটি মনে করে অনেক কষ্ট হচ্ছে রাতুলের। তবুও মেয়েটিকে বুঝতে না দিয়ে সে জিঙ্গেস করলো,খুলনায় কোচিং করলে তোমার কি কোন সমস্যা হবে ?
আব্বু ভাবছে ঢাকায় থাকলেই আমার নিরপত্তা বেশী এ জন্য।
কোন তর্ক না করে রাতুল ভাবতে লাগল, অনেক দিন পর তাকে দেখতে আমার যেমন খুব ইচ্ছা হচ্ছে, নিশ্চয় আমাকে দেখতে তারও খুব ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু তার বাবা খুলনায় না রেখে ঢাকায় চাচা-চাচীর বাসায় রেখে কোচিং করাতে চাচ্ছে! নিশ্চয় এখানে তার জন্য বেশী নিরাপদ। তা নাহলে তার বাবা সেখানে রাখবেনই বা কেন?
কথাগুলো নিয়ে ভাবতে গিয়ে মেসেজের রিপ্লাই দিতে দেরি হওয়ায় মেয়েটি মেসেজ পাঠালো, কি হলো? তুমি মেসের উত্তর দাও না কেন?
লজ্জ¦ায় নিজেকে আত্মগোপন করার জন্য সে মেয়েটিকে বলল, তোমার সাথে কিছুক্ষণ পরে কথা বলছি।
দুই
পড়ালেখায় আর মন বসছে না রাতুলের।বিজ্ঞ রাতুল তার মনের মানুষটির উপর অভিমান না করে বরং মেসেজের প্রথম দুটি কথা নিয়েই ভাবতে বসেছে।
১) মেয়ে হিসেবে জন্ম নেওয়াই পাপ! এ-সমাজে বাক্যটা আসলেই তার জন্য সত্য, নাকি না? অনেক ভেবে চিšেত সে সিদ্ধান্ত নিল তার মনের মানুষটির এ কথাটি যে একেবারেই যে মিথ্যা তা কিন্তু নয়। কেননা তার কোন ভাই নেই। তার পিতা-মাতার তিনটি সন্তানই মেয়ে। যেটা এ সমাজে তার মাতা-পিতার জন্য চিন্তার কারণ। আর সে চিন্তা অন্য কোন কারনে নয়, তিন কন্যা সন্তানের নিরাপত্তা নিয়েই তাদের যত মাথা ব্যাথা। মেয়েগুলোকে যদি গ্রামে রাখা হয় তাহলে প্রতিদিন একডজন দূত আসবে বিয়ের পয়গাম নিয়ে। আর দূতদের কথা সাড়া না দিলে সেখানে শুরু হবে আরেক সমস্যা।বিবাহের বয়স হয়ে যাওয়ার পরও কন্যাদের বিয়ে না দেওয়ায় সমাজে তাদের নিয়ে শুরু হবে হাজারো জল্পনা-কল্পনা। মাঝেÑমাঝে নিকটাত্মীরাও আসবে আত্মীয়তার সম্পর্ক গভীর ও স্থায়ী করার জন্য মেয়েগুলো তাদের পুত্র বধু বানাতে। কিন্তু তাদেরকে যে তাদের পিতা-মাতার অনেক বড় করার ইচ্ছা! এজন্য আত্মীয়দের কথায় রাজি না হলে তাদেরকে হতে হবে আত্মীয়চ্যুত।
গ্রামের এসকল সমস্যা থেকে রেহাই পেতে তাদেরকে শহরে পাঠালে সেখানে শুরু হবে অন্য সমস্যা। সেখানে তারা একা একা চলবে কিভাবে? তাদের সাথে যে কোন প্রহরী(পুরুষ)নেই। চারপাশের কামুকদের হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করবে কে? আর ঘটনাক্রমে মেয়েগুলো যদি সে সকল কামুকদের থাবায় আটকা পড়ে তাহলে তো ধর্ষণ শেষে মৃত্যু নিশ্চিত। আর সৌভাগ্যক্রমে(নিন্দার্থে)ধর্ষন শেষে বেঁচেই বা যদি যায় তখন তাদেরকে প্রস্তুত হতে হবে অজানা এক জগতের সাথে লড়াই করার জন্য। কেননা তখন যে তাদের গায়ে লেগে যাবে ধর্ষিতার তকমা। তখন তারা না পারবে এ সভ্য সমাজে (অবাজ্ঞার্থে) মুখ দেখাতে, না পারবে আত্মতৃপ্তি নিয়ে বাঁচতে। আর পদে পদে লাঞ্চিত হয়ে বাঁচতে হবে তাদের পিতা-মাতার। নতুবা বাবা-মেয়ে একসাথে আত্মহত্যা করতে হবে ট্রেনের নিচে কাঁটা পড়ে। সবাই তখন তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। এমনকি আমিও। আমিও তখন আমার প্রিয়তমাকে ধর্ষিতা হিসেবে জানবো। কিন্তু যাদের স্পর্শে আজ তারা ধর্ষিতা, তারা ঠিকই এ সমাজে পবিত্র হিশেবে গণ্য হবে। সারাদিনে কয়জনকে ধর্ষণ করলো দিনশেষে তারা তা নিয়ে হিশেব করতে বসবে। আর অভিমানে মেয়েগুলো যদি আইনের দ্বারস্থ তাহলে পড়বে নতুন যন্ত্রনায়। কেননা,আইন তার নিয়ম-নীতি গুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য হায়েনাগুলোকে আটক করবে ঠিকই। কিন্তু প্রযোগ করার ক্ষমতা এ সমাজের কাছে হারিয়ে ফেলবে। সমাজ তখন হায়েনাগুলোকে অবুঝ শিশু বলে আখ্যায়িত করবে। তখন আইনের কি আর ক্ষমতা আছে সমাজের কথার বাইরে যাওয়ার?
মেয়েগুলোর জন্য তৈরী হবে কৃষ্ণ গহব্বর। হয়তো মেয়েগুলোর পিতা-মাতা অসত্যগুলো গোপন রেখে কোন ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার সুযোগ এবার তা হারিয়ে ফেলল। কেননা আইনের দ্বারস্থ হওয়ায় সারা দেশ যে এবার তাদেরকে ধর্ষিত হিসেবে চিনে ফেলেছে। এখন আর তাদেরকে গ্রহন করবে কে?
মেয়েগুলোকে এবার মেনে নিতে অভিশপ্ত জীবনের করুন পরিনতি। কেননা তারা যে ধর্ষিতা। যে সমাজ তাদেরকে ধর্ষিতা বলে স্বীকৃত দিয়েছিল, সে সমাজ এবার নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য তাদেরকে নির্জনে আমন্ত্রণ করবে। তাদের ডাকে সাড়া দিলে মেয়েগুলো হয়ে গেল বেশ্যা আর সাড়া না দিলে হয়ে গেল অস্পৃশা। জ্ঞানগর্ভ রাতুল সমাজের এই চিত্র ভেবে সিদ্ধান্ত নিল,তার প্রিয়তমাতো মিথ্যা কিছু বলিনি। আসলেই এ সমাজের জন্য তাদেরকে মেয়ে হিসেবে জন্মানোটাই পাপ!
২) এবার সে ভাবতে বসলো তার প্রিয়তমার দ্বিতীয় কথাটি নিয়ে,আপনাদের ছেলেদের কোন কাজের জন্য কাউকে হিশেব দিতে হয় না অথচ মেয়েদের প্রত্যেকটা পদে পদে হিশেব দিয়ে চলতে হয়। আর সেখানে সামান্য ভুল করলেই ব্যার্থ। কথাটি আসলেই কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
অনেক ভেবে চিন্তে রাতুল সিদ্ধান্ত নিলো, কথাটিতো অনেকটা যুক্তিযুক্ত। কেননা,রমজানের ছুটিতে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও আম্মুকে যখন বললাম, আমার সমস্যা আছে আমি এখন বাড়িতে আসবো না। আম্মু একটিবারও আমার বাড়ি না যাওয়ার কারণ শুনলো না। কিন্তু আমার জায়গায় যদি আমার প্রিয়তমা থাকতো তাহলে তাকে হাজার জনকে হাজার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া লাগতো। আমিই তাকে জিঙ্গেস করতাম, অনেদিন তোমাকে দেখিনা,বাড়িতে চলে আসো। তোমার এখন ক্যাম্পাসে থাকার দরকার কি?তার বাবা তাকে বলতো, তোর বান্ধুবীরা সবাই বাড়িতে চলে গেছে তুই একা একা ক্যাম্পাসে থেকে কি করবি?মা বলতো, সবাই বাড়িতে চলে গেছে তোর নিরাপত্তা থাকবে না।তুই বাড়িতে চলে আয়।বান্ধুবীরা কটাক্ষ করে বলতো, কিরে,আমরা সবাই বাড়িতে চলে আসছি। অথচ তুই বাড়ি না গিয়ে এখনো ক্যাম্পাসে পড়ে আছিস! নতুন কারো প্রেমে পড়েছিস নাকি? এই চিরচেনা মানুষগুলোও অপরিচিত হয়ে উঠতো তখন। সুতরাং কথাটাতো আমার প্রিয়তমা মন্দ বলিনি।
তাহলে দোষ দিবো কাকে? প্রিয়তমাকে নাকি তথাকথিত সভ্য সমাজকে? আচ্ছা,সম্পূর্ণ দোষটা ঐ মজলুম মেয়েটাকেই দিলাম। কেননা সে তো মেয়ে !আজ যদি সে মেয়ে না হয়ে ছেলে হতো তাহলে তো সমাজ তাকে নিয়ে এমনটা খেলার সাহস পেত না। এসব ভাবতে ভাবতে মনের অজান্তেই রাতুল কখন যেন বলে ফেলল, হে প্রভু!এই স্বার্থানেষী কলুষিত সমাজ হতে তোমার মজলুম বান্দেটিকে বাঁচাও, না হয় তার হাত থেকে এ সমাজকে বাঁচাও। আর সে সমাজের মধ্যে আমিও একজন।
জি,এম,ইমরান হোসেন।
সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।