নিজস্ব প্রতিবেদক:
সাম্প্রতিককালের বন্যার ক্ষত আজও কাঁদাচ্ছে কুড়িগ্রামের ৩০টি পরিবারের শত শত মানুষকে। বন্যা শেষ হওয়ার ৩ মাস অতিবাহিত হতে চললেও এসব এলাকার মানুষের সব হারানোর বেদনার কান্না প্রতিদিনেই চোখ থেকে পানি ঝরাচ্ছে। তাদের স্বপ্নের বাড়িঘর, আবাদি জমি আজও নিমজ্জিত রয়েছে গভীর পানিতে। ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের চরবড়লই ও পার্শ্ববর্তী এলাকা কুড়িগ্রাম সদরের হলোখানা ইউনিয়নে এসব পরিবারের বসবাস।
তাদের খাদ্যের যোগানের সম্বল ৫০ বিঘার মতো আবাদি জমিতে বালু জমে মরুভূমি হয়েছে। বাড়িঘর হারিয়ে এসব মানুষ এখন পাকা রাস্তায় আশ্রয় নিয়ে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো কষ্টে দিনাতিপাত করলেও তারা ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। আবাদি জমিগুলোতে ফসল ফলিয়ে কষ্ট লাঘবের সুযোগ থাকলেও জমিগুলোতে বালুর স্তুপ পড়ায় সেখানে ফসল চাষের আর সুযোগ নেই। ফলে অনাহারে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে এসব ক্ষতিগ্রস্তরা।
এখানকার ক্ষতিগ্রস্তরা হলেন- ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের চড়বড়লই গ্রামের আব্দুল খালেক, আক্কাছ আলী, আইয়ুব আলী, আলেফ মিয়া, নালু মিয়া, হাবিব মিয়া, আ. মালেক, তৈয়ব আলী, তৌদিুল ইসলাম, আলম মিয়া, নজেমুদ্দিন, মজেমুদ্দিন, জয়েন উদ্দিন, জুয়ের মিয়া, রেজাউল হক, নবীর হোসেন, মজিবর রহামান, মনছার আলীসহ আরো অনেকে।
চরবড়লাই গ্রামের পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রাম সদরের হলোখানা ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্তরা হলেন- মোজাম্মেল হক, সফিকুল ইসলাম, আমজাদ মাস্টারসহ আরো অনেকে। সরেজমিন দেখা যায়, সবার বাড়িঘর বসতভিটা ভেঙে গভীর পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। এখানে দোতলা ফাউন্ডেশনের বিল্ডিংঘর, পাকাঘর, টিনশেড ঘর, গৃহপালিত গরু ছাগল-হাঁস-মুরগির ঘরসহ অর্ধশত বাড়িঘর বন্যায় ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে আজও পানির নিচে নিমজ্জিত হয়ে আছে।
চরবড়লই গ্রামের শতবর্ষী বৃদ্ধ মোহাম্মদ আলী বলেন, আমাদের বসতভিটাটি এখন পারাপারের নদী হয়েছে। বাপ-দাদার আমল থেকে এখানে আমরা সুখে থাকার জন্য পাকা ঘরবাড়ি নির্মাণ করেছিলাম। আল্লাহর রহমতে সুখে দিন কাটতেছিল। কিন্তু কোন যে গজব এসে এক নিমিষেই স্বপ্নের বসতভিটা ও ঘরবাড়িকে গভীর পানিতে তলিয়ে দিলো তা বুঝতে পারলাম না।
তিনি গভীর পানি হাত দিয়ে দেখিয়ে বলেন, এই পানিতে এখনও তলিয়ে আছে আমার ৪টি পাকা ঘর। বৃদ্ধ তার নিজের হাতের তৈরি বসতভিটা ফিরিয়ে আনতে ভাঙন স্থানে মাটি ভরাটের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। মাটি ভরাট করা না হলে সামনের বন্যায় এখানকার আশপাশের আরও কয়েকটি গ্রামের বাড়িঘর বসতভিটা পানির তলে নিমজ্জিত হবে বলে জানান ক্ষতিগ্রস্তরা।
একই এলাকার মনছের আলী (৫০) জানান, তাদের ঘরবাড়ি ও বসতভিটা এখন প্রায় ১৫০ ফুট দৈর্ঘ্যর পারাপারের নদী হয়েছে। মানুষ এখন যাতায়াতের জন্য তাদের বসতভিটার উপর দিয়ে ভেলার সাহায্যে পারাপার করছে। এ সময় তিনি বলেন, আমরা সরকারের কাছে ত্রাণ চাই না। ভাঙন স্থানে সরকার দ্রুত মাটি ভরাটের ব্যবস্থা করুক। এই দাবি আমরা করছি।
ওই এলাকার শিক্ষিত যুবক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, গত ১০ আগস্ট থেকে বন্যা শুরু হলে আমাদের বাড়ির পাশের পাকা পাকা সড়কের নিচ দিয়ে পশ্চিম দিক থেকে আসা বন্যার পানি ইঁদুরের গর্ত দিয়ে পাকা সড়ক পাড় হয়ে পূর্বদিকে যাচ্ছিল। আমরা আশঙ্কা ভেবে ইঁদুরের গর্তটি বন্ধ করার চেষ্টা করি। কিন্তু সম্ভব হয়নি।
আমাদের চোখের সামনেই মুহূর্তের মধ্যে পাকা সড়কটি ছিঁড়ে গিয়ে আমাদের স্বপ্নের পাকা, কাঁচা, টিনশেডের বাড়িঘর ও বসতভিটা সর্বনাশা বন্যা ভেঙে নিয়ে যায় ও বসতবাড়ির স্থানটিকে একটি গভীর নদী রুপে পরিণত করে। তারা শুধু প্রাণে বাঁচলেও তাদের বাপদাতার বসতভিটা হারিয়ে এখন নিঃস্ব জীবনযাপন করছেন।
এ বিষয়ে বড়ভিটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খয়বর আলী জানান, ভাঙন এলাকাগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে পরিমাপ করা হয়েছে। এতে তার এলাকার ৬০০ থেকে ৭০০ ফুট ভাঙা স্থান পরিমাপ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন এলাকাগুলোতে মাটি ভরাটের কাজ করার কথা রয়েছে বলে জানান তিনি। এ ব্যাপারে ফুলবাড়ী উপজেলা প্রকৌশলী শামছুল আরেফীন খান জানান, চরবড়লইসহ উপজেলার অন্যান্য ভাঙন এলাকার ইস্টিমেট ও রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ এলে এসব ভাঙন এলাকায় কাজ শুরু হবে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ