নিজস্ব প্রতিবেদক:
জন্ম থেকেই নির্যাতিত রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের এই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীটি জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় নিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তবে চলতি বছরের ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গা নির্যাতনের ভয়াবহতা পূর্বের সব ইতিহাসকে ছাড়িয়ে যায়। জাতিসংঘ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই নৃশংসতাকে ‘জাতিগত নিধনের ধ্রুপদী উদাহরণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগেরই আশ্রয়দাতা বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বর্তমানে শরণার্থী হিসেবে রয়েছে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা। রাখাইন থেকে এসব রোহিঙ্গা শুধু জীবন নিয়েই পালিয়ে আসেনি, বরং শরীরজুড়ে নিয়ে এসেছে নির্যাতনের চিহ্ন, ক্ষত। অত্যাচারের সেসব ছবি দেখলে শিউরে উঠবে সাধারণ মানুষও। মিয়ানমার সেনাদের রোহিঙ্গা নির্যাতনের কিছু প্রমাণ ধরা পড়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ক্যামেরায়। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী শিবির থেকে তোলা হয় ‘চোখ ভিজিয়ে দেওয়া’ ওই ছবিগুলো।
পোড়া শরীর আর ঝাপসা চোখই তাঁর সম্বল ২১ বছর বয়সী এই রোহিঙ্গা তরুণের নাম মুহাম্মদ জুবায়ের। মিয়ানমার সেনাদের ছোঁড়া বোমার আঘাতে সারা শরীরই পুড়ে যায় তাঁর। পাশবিক নির্যাতনে হারাতে বসেছিলেন দৃষ্টিশক্তিও। ঝাপসা চোখের নিথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি অনেক সপ্তাহ ধরে চোখে কিছুই দেখতে পেতাম না। পরে কক্সবাজারের একটি হাসপাতালে ২৩ দিন ভর্তি ছিলাম। আমি ভেবেছিলাম আর কোনোদিন কিছু দেখতে পাব না।’
হামলার দিন থেকে একটিও কথা বলেনি সেতারা রাখাইনে আট ভাইবোনের সঙ্গে বাসার ভেতরে ছিল সেতারা বেগম। সে সময়ই রকেট হামলা চালায় মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। আগুনের মধ্যে থেকেই উদ্ধার করা হয় ১২ বছরের সেতারার পোড়া শরীর। কিন্তু কপালে জোটেনি সামান্য চিকিৎসা। ফলে ধীরে ধীরে সে সুস্থ হলেও হারাতে হয়েছে পায়ের সবকটি আঙুল। হামলার দিন থেকে সেতারা একটি কথা বলেনি বলে জানান তার মা।
‘তারা আমার মাথায় ছুরি দিয়ে কোপায়’ কতই বা বয়স নূর কামালের? খাতা-কলমের হিসাব বলছে ১৭ বছর। সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ভয়ে ঘরের এক কোণে লুকিয়ে ছিল সে। সেনা সদস্য কিশোরটিকে সেখান থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে। কামাল বলে, ‘ওরা আমার মাথায় প্রথমে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে। তারপর ছুরি দিয়ে কোপাতে থাকে।’ রক্তের স্রোতের ভেতর থেকে কামালকে উদ্ধার করেন তার চাচা। পরে তাঁদের সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ছোট্ট কামাল। ‘ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছিল, তাও দৌড়েছি’
পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছিলেন ৭৩ বছরের বৃদ্ধ আবদুর রহমান। এমন সময়ে তাদের ওপর হামলা চালায় হানাদার সেনারা। দূর থেকে তাঁর দিকে ছুড়ে দেওয়া হয় একটি ছুরি। এতে পায়ের তিন আঙুল কেটে যায় আবদুর রহমানের। তিনি বলেন, ‘ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছিল। তাও দৌড়েছি। ওই অবস্থায় আরো দুই ঘণ্টা হাঁটার পর বাংলাদেশে পৌঁছাই।’
তিনি নির্যাতিতা, হারিয়েছেন তিন সন্তান প্রথমে মমতাজ বেগমকে পেটানো হয়। তারপর ঘরের ভেতর আটকিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আগুন। কোনোমতে ঝলসানো শরীর নিয়ে ঘরের বাইরে আসেন তিনি। বাইরে পড়েছিল তিন ছেলের মৃতদেহ। একমাত্র মেয়ে মাটিতে পড়ে রক্তাত্ব অবস্থায় কাতরাচ্ছিল। এখন বাংলাদেশের একটি চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি রয়েছেন মমতাজ। অনেকটা সুস্থ তিনি। তবে ঝলসানো শরীর ও বীভৎস ব্যান্ডেজ দেখলে সেদিনের না দেখা নির্যাতনের ঘটনাও সবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
‘আমার আনসারের সঙ্গে আল্লাহ কেন এমন করলেন?’ শরণার্থী শিবিরের এক কোণে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় ক্যামেরার ফ্রেমবন্দি হয় ১১ বছরের শিশু আনসার উল্লাহ। পায়ে দগদগে ক্ষতচিহ্ন। আনসারের মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমাদের দিকে তারা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি করছিল, আমাদের বাসা তখন জ্বলছিল, সে কথা ভুলতে পারি না। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা সবাই কমবেশি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের চিহ্ন বহন করছে। কেউ শারীরিক আবার কেউ মানসিকভাবে। রয়টার্সের ক্যামেরায় ধরাপড়া আনসার, কামাল আর মমতাজরা তাদেরই দু-তিনজন মাত্র। ফ্রেমের বাইরেও রয়েছে রোহিঙ্গাদের ভেজা চোখ ও নির্বাক দৃষ্টিতে ফুটে ওঠা আজন্ম অসহায়ত্বের গল্প। এমন হাজারো গল্পের রোহিঙ্গাকথা খুঁজে পাওয়া যাবে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোর আনাচকানাচে। কিন্তু সেসব কথা কে শুনবে, এটাই প্রশ্ন।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ