নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাস্তা নেই, স্কুল নেই, হাসপাতাল নেই, যানবাহন নেই তবুও তারা অবিরাম চলছে সামনের দিকে। যমুনা পাড়ের মানুষদের হাজারো প্রতিকূল অবস্থার মোকাবেলা করতে হয় প্রতিনিয়তই। বিচিত্র রকম বৈরী পরিবেশের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় তাদের। কাছে গিয়ে না দেখলে বোঝার উপায় নাই। কখনো নদী ভাঙন, কখনো বন্যার আঘাত সহ্য করতে হয় তাদের। এই কূল ভাঙলে ওই কূলে আবার নতুন করে ঘর বাঁধে তারা। শতশত ঘরবাড়ি প্রতি বছর গিলে খায় যমুনা। তারপরেও নদীপাড়ের এই মানুষগুলো চর ছাড়তে রাজি না। বর্ষায় অথৈ পানি আর শুকনা মৌসুমী তপ্ত বালি কণার সাথে তাদের দৃঢ় মিতালী।
যমুনা ব্রিজের পশ্চিম পাশ থেকে শুরু করে উত্তরপ্রান্ত কুড়িগ্রাম পর্যন্ত যমুনার অববাহিকায় দেড় হাজারের বেশি চর জেগেছে। এসব চরের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন শতাধিক চরে মানুষ বসবাস করে। শিক্ষার আলো, স্বাস্থ্য সেবা, সড়ক সেবাসহ প্রায় সবধরনের নাগরিক সেবা বঞ্চিত বরাবরই এই মানুষগুলো। বালির মাঝেই চাষাবাদ এবং গরু ছাগল পালন এদের প্রধান পেশা। এখন অবশ্য অনেক চরে মরিচ, আলু, বাদাম, গোম, ভুট্টাসহ প্রায় সব রকমের ফসলের চাষ হয়। তারপরেও এই চারের কৃষিকরা বঞ্চিত কৃষি সেবা থেকেও। কিছু না পেলেও এই মানুষগুলোর না পাওয়ার কোনো অভিযোগ নেই।
সারিয়াকান্দি উপজেলার চন্দনবাইশা চরের জমিল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা চরের মানুষ নিজেদের মতো করে ভালো আছি। আমরা ভালো থাকতে চাই। কারো কাছেই আমাদের চাওয়ার কিছু নেই।’
জনবসতি এসব চর এলাকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চর হচ্ছে, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, টেংরাকান্দি, গাবগাছি, পারুল, খাটিয়ামারি, গলনা, খোলবাড়ি, সাঘাটা উপজেলার দিগলকান্দি, পাতিলবাড়ি, গুয়াবাড়ি, গাড়ামারা, হরিচন্দ্র, এজেন্ডাবাড়ি, বগুড়ার ধুনটের, বৈশাখী, ভান্ডাবাড়ি, মাঝিরারচর সারিয়াকান্দি উপজেলার ধারাবর্ষা, শংকরপুর, চন্দনবাইশা, চরলক্ষিকোলা, ডাকাতমারিরচর, ইন্দুরমারিরচর, চরকর্নিবাড়ি, তালতলা, বেনুপুর, পাকুরিয়া, চরমানিকদাইর, চরদলিকা, শিমুলতাইড়, চরকালুয়াবাড়ি, চরবিরামেপাচগাছি, নয়াপাড়া, জামথল, চরবাকিয়া, ময়ূরেরচর, চরদেলুয়াবাড়ি, কুড়িপাড়ারচর, চরশালিকা, করমজাপাড়া, টেকামাগুড়ারচর। এসব চর ছড়াও যমুনাপড়েরর আরও অসংখ্য চর আছে। এসব চরের মানুষেরা আধুনিক বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে এখনো অবস্থান করছে। অনেক এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। বিদ্যুৎ তাদের কাছে কল্পনার বিষয়। সমসাময়িক প্রেক্ষাপট, দিন-দুনিয়ার অনেক তথ্য থেকে তারা এখনো অনেক ব্যবধানে আছে।
বেশির ভাগ চরে বালির মাটি হওয়ার কারণে রাস্তা বাধার কোনো পরিস্থিতি নেই। তবে যে সব চর দীর্ঘদিন আগে জেগেছে সে সব চরে এখন দোআঁশ, এটেল মাটির স্তর তৈরি হয়েছে। এসব এটেল, দোআঁশ মাটির চরগুলোতেও রাস্তা ঘাট চোখে পড়ে না। দশ বিশ কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটেই তাদের বাজারে কেনাবেচা করতে হয়। বিশেষ করে এসব চরাঞ্চলের কৃষিপণ্য বিক্রির সময় চাষিদের বিপাকে পড়তে হয়। ঘারে পিঠে বহন করেই বাজার পর্যন্ত আনতে হয় তাদের। তবে বর্ষা মৌসুমে প্রতিটি বাড়ির কিনারায় পানি ওঠায় নৌকায় এসব পণ্য বহন করতে সুবিধা হয়। এই সুবিধা বেশি দিন স্থায়ী হয় না। মাস দুয়েক পরে আবারো পূর্বের হলে চলে চরের মানুষ।
আমাদের দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মানুষ নদী অববাহিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তাদের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা এবং চরের উন্নয়নের জন্য সরকারকে আরও বেশি নজর দেয়া জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
চরের মানুষের স্বাস্থ্যবেসা নিশ্চিত করার জন্য স্থায়ী চিকিৎসালয় স্থাপন করা সময়ের দাবি। বিশেষ করে একজন সন্তানসম্ভবা নারীর যখন প্রসব ব্যথা ওঠে কখন তাদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেয়ার কিছুই থাকে না এসব এলাকায়। এছাড়াও শিশু-বৃদ্ধরা অসুস্থ হয়ে পড়লে একই অবস্থা। প্রাচীন পদ্ধতি কাঠের চৌকিতে রোগীকে শুয়ে তাতে বাঁশ লাগিয়ে ঘাড়ে করে বহন করে অনেকপথ পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে আনতে হয়।
শিক্ষা উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় চরের শত শত শিশু প্রথমিক শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। হাতে গোনা কিছু চরে প্রাথমিক শিক্ষার স্বল্প পরিসরে থাকলেও বেশির ভাগ চরেই নেই। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় চরের শিশু কিশোররা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে শ্রমের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। মেয়েদের কিশোরীকালেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছে পরিবারের পক্ষ থেকে। এই আধুনিক বাংলাদেশে এই অঞ্চলগুলোতে এখনো বাল্যবিবাহ প্রতিনিয়তই হচ্ছে।
দেশ সামনের দিকে এগুলেও দিনদিন পেছনের পথে হাঁটছে চরের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মানুষ। তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনে কেউ না এলেও নিজেরাই সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু চরে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে স্বপ্ল পরিসরে। বিস্তর পরিসরের ডিশ না থাকলেও স্থানীয়ভাবে ছোট ছোট ডিশ এন্টেনার সংযোগে চলছে টেলিভিশন। তাদের প্রচেষ্টার পাশাপাশি সরকার ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান পাশে দাঁড়ালে চরবাসীর জীবনযাত্রার মান কিছুটা হলেও বড়বে বলে মনে করছেন তারা।
এদিকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো ছাড়া এই মানুষগুলোর কোনো কাজে পাশে আসে না বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতি পাঁচ বছর পরপর নেতাদের সাময়িক পদচারণা দেখা গেলেও ভোট শেষে চরের বালুতে আর কখনো পা রাখেন না তারা। তবুও ভালো আছেন বুক ফুলে বলে দাবি করেন চরের সাহসী মানুষগুলো।
স্থানীয় সাংবাদিক ইমরান হোসেন রুমেল জানান, চরের মানুষ বরাবরেই অনেক কষ্টে থাকে। তাদের জীবন যাত্রার মান নিম্নমানের। বিশেষ করে শুকনা মৌসুমে যাতাযাত ব্যবস্থা খুবই নাজুক হয়। পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল তাদের পাড়ি দিতে হয়।
স্থানীয় চেয়ারম্যান রনি জানান, চরের মানুষ প্রতিনিয়তই প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে চলে। বর্ষার সময় নদীর পানি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। আবার শুকনা মৌসুমে তীব্র তাপদাহে জীবন অতিষ্ট হয়ে উঠে। তিনি বলেন, এতো কিছুর পরেও নদীপাড়ের এসব মানুষ নাদী এবং চরকে ছাড়তে পারে না।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ
Daily Deshjanata দেশ ও জনতার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর

