আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন দেশটির রাজধানী তেহরানের রক্ষণশীল মেয়র মোহাম্মদ বাঘার ঘালিবাফ। ফলে শুক্রবার অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে রক্ষণশীল ভোটারদের ভোট ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেল। কারণ, মাঠে আছেন আরেক ডানপন্থি ক্ষমতাশালী প্রার্থী এবরাহিম রাইসি। আগেও দু’বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হন বাঘার ঘালিবাফ। এবারের নির্বাচন থেকে তিনি সরে আসায় সংস্কারপন্থি ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির জয়ের সম্ভাবনা আরো কঠিন হয়ে পড়েছে। গার্ডিয়ানের এক খবরে বলা হয়, সোমবার এক বিবৃতিতে নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন তেহরানের মেয়র। বিবৃতিতে তিনি বলেন, এবরাহিম রাইসির জয়ের সম্ভাবনা বাড়াতেই তিনি সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।
রাইসি ইরানে ব্যাপক ক্ষমতাশালী। ইরানের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি তথা সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহর পদেও তিনি স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন বলে প্রচার রয়েছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি নির্বাচিত হলে তার সুপ্রিম লিডার হওয়ার সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হবে। আর হারলে হতে পারে উল্টোটা। আধা-সরকারি ফার্স বার্তা সংস্থার এক সংবাদে বলা হয়, ঘালিবাফ বিবৃতিতে বলেন, ‘এখন গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষ, দেশ ও বিপ্লবের স্বার্থসংরক্ষণ করা। আর বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তন ছাড়া তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিপ্লবের পক্ষের লোকদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করার এক মৌলিক সিদ্ধান্ত আমাদের নেয়া উচিত। দেশজুড়ে আমার সকল সমর্থকের প্রতি আহ্বান, আপনারা আমার সম্মানিত ভাই হুজ্জাত আল-ইসলাম এবরাহিম রাইসির পক্ষে মাঠে নামুন। মর্যাদা ও কর্মের এক সরকার গঠনে তাকে সাহায্য করুন।’
২০১৩ সালের নির্বাচনে অবশ্য ঘালিবাফ মাত্র ৬০ লাখের মতো ভোট পেয়েছিলেন। অপরদিকে রুহানি ১ কোটি ৮৬ লাখ ভোট তথা মোট ভোটের ৫০.৭১ শতাংশ পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ইরানের নিয়ম অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট হতে হলে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ভোট পেতে হবে প্রার্থীকে। ইরানে গ্রহণযোগ্য কোনো মতামত জরিপ আয়োজক নেই। ফলে রক্ষণশীল প্রার্থী এবরাহিম রাইসি ইরানে কতটা জনপ্রিয় তা যাচাই করার সুযোগ নেই। এর আগে তিনি কখনো প্রেসিডেন্ট পদেও লড়েননি।
রাইসি ইরানের সাবেক প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন। কয়েকদিন আগেও উত্তরাঞ্চলীয় খোরাসান-রাযাভি প্রদেশের বাইরে তার অত পরিচিত ছিল না। খোরাসান-রাযাভি প্রদেশের আস্তান কুদস রাযাভি নামে একটি দাতব্য সংস্থার তত্ত্বাবধায়ক তিনি। এই সংস্থা পুরো মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ধনাঢ্য দাতব্য সংস্থা। মাশদাদে অবস্থিত ইরানের পবিত্রতম মাজার অর্থাৎ ইমাম রেজার মাজার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও পালন করে আস্তান কুদস রাযাভি। ১৯৮৮ সালে তিনি ইরানের চার শরিয়া বিচারকের একজন ছিলেন। ওই আদালত বামপন্থি ও ভিন্নমতাবলম্বি অনেকের মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করেন। রাইসির এমন মানবাধিকার রেকর্ড অনেকের জন্যই উদ্বেগজনক। নিউ ইয়র্কভিত্তিক ‘হিউম্যান রাইটস ইন ইরান’-এর নির্বাহী পরিচালক হাদি ঘায়েমি বলেন, ‘ইরানের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম অপরাধের জন্য যে লোকটির বিচারের কাঠগড়ায় থাকা উচিত ছিল সে এখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ছে।’
রাইসির ওই মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রসঙ্গে তার প্রতিপক্ষ ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট রুহানিও অভিযোগ এনেছেন। তিনি সম্প্রতি এক নির্বাচনী জনসভায় বলেন, ‘ইরানের জনগণ এ নির্বাচনে ঘোষণা দেবেন যে, তারা এমন লোককে গ্রহণ করবেন না যারা ৩৮ বছর ধরে শুধু ফাঁসি আর কারাগারই চিনেছে।’
২০১৫ সালে যুগান্তকারী ইরান পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এটিই দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৫ সদস্য রাষ্ট্র ও জার্মানির সঙ্গে করা ইরানের ওই চুক্তি মোতাবেক, নিজেদের পারমাণবিক কর্মসূচির পরিসর কমিয়ে আনার বিনিময়ে দেশটির ওপর বিপুল অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়। ২০১৫ সাল থেকে রুহানির অধীনে ইরানের অর্থনৈতিক অগ্রগতিই এ নির্বাচনের মূল প্রশ্ন।
রুহানি ইরানের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করেছেন। কমিয়ে এনেছেন মুদ্রাস্ফীতি। তবে দেশটিতে বেকারত্বের হার এখনো বেশি। তার প্রতিপক্ষরা তাই প্রশ্ন তুলছেন, দেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আনয়নে রুহানি যথেষ্ট কিছু করেছেন কিনা। এছাড়া চুক্তির ফলে ইরানের পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হওয়ার উচ্চকাঙ্ক্ষা আপাতত বিলীন হওয়ায় অনেক কট্টরপন্থি রুহানির ওপর ক্ষুদ্ধ। তবে এখন পর্যন্ত ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নেননি এমন প্রায় ২ কোটি ভোটারের ওপর নির্ভর করছেন রুহানি। সম্প্রতি প্রভাবশালী অনেক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তাকে সমর্থন দেয়ায় তিনি সুবিধাজনক স্থানে রয়েছেন। ইরানের জন্য দু’বার অস্কারজয়ী পরিচালক আশঘর ফারহাদি রুহানির সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন। দেশের সংখ্যালঘু সুন্নি সম্প্রদায়ের নেতারাও তাকে সমর্থন দিচ্ছেন।
দেশ জনতা/এন এইচ