দৈনিক দেশজনতা অনলাইন ডেস্ক:
মিয়ানমারে বিশ্ব চাপে পাশবিক নির্যাতন বন্ধ হলেও বেড়েছে মানসিক নির্যাতনের মাত্রা। ফলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার স্রোত কোনমতেই কমছে না। প্রতিদিন রোহিঙ্গারা আসছে দল বেঁধে। চলতি সপ্তাহের শুরুতে নতুন করে ঢুকছে প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গা। সীমান্তের বাংলাদেশ অভিমুখে জড়ো হয়ে আছে আরো ৮ থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গা। কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া পার হতে না পেরে গতকাল রোববার রাত থেকেই ওখানে আটকা পড়ে আছে এসব রোহিঙ্গা।
খাদ্য অবরোধ ও রোহিঙ্গাদের ক্ষেতের পাকা ধান, গরু ও অন্যান্য সরঞ্জাম লুট করায় সেখানে এতদিন থেকে যাওয়া লোকজন নতুন করে বাংলাদেশ অভিমুখী হচ্ছে। কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা ডা. জাফর আলম এসব তথ্য জানিয়েছেন। রোহিঙ্গা নেতা ডা. জাফর আলম জানান, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চাপে এখন পাশবিক আচরণ বন্ধ হলেও চলাচল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য প্রাপ্তিতে একপ্রকার অবরুদ্ধ হয়ে আছে মিয়ানমারে অবস্থানকারীরা। তিনি জানান, রাখাইনের সীমান্তবর্তী এলাকা চাকমাকাটা, রাইমংখালী ও প্রংচোমং এলাকায় রোহিঙ্গাদের লাগানো ধানে পাক ধরেছে। অবরোধ ও খাদ্যাভাবের যন্ত্রণার সঙ্গে পাকা ধানগুলো সেনা ও বিজিপি কেটে নিচ্ছে। বাড়ি বাড়ি থেকে পুরুষদের ধরে নিয়ে ধানকাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা যেতে চান না তাদের ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে দেয়া এক ধরনের কার্ড। যেসব বাড়িতে পুরুষ নেই সেখানে থাকা নারীদের সঙ্গে অসভ্য আচরণ করা হচ্ছে। চতুর্মুখী মানসিক চাপে পড়ে সর্বশেষ বাপ-দাদার ভিটা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই বাংলাদেশের পথে পা বাড়ায় নিপীড়িতরা। এখানেও তাদের ভাগ্য মন্দ। চলতি সংকট শুরুর পর নতুন করে মেরামত করা কাঁটাতারের বেড়া কোনমতেই ডিঙ্গাতে না পেরে সেখাইে দু’দিন ধরে অবস্থান করছেন তারা। মুঠোফোনেই তিনি এসব জেনেছেন বলে দাবি করেন। তথ্যটি শুনেছেন দাবি করে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির উপ-অধিনায়ক মেজর মো. ইকবাল আহমেদ বলেন, প্রায় সময় বিচ্ছিন্ন ভাবে রোহিঙ্গা আগমন ঘটছে। আমাদের জোয়ানরা তাদের ধরে জিরো পয়েন্টে জমায়েত করে। ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশনা পেলে আমরা তাদের ক্যাম্পে পৌঁছেছি। সেভাবে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার কুতুপালং ক্যাম্পে নতুন প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় নেয়া হয়। গতকাল রোববার সকাল থেকে খবর পাচ্ছিলাম ওপার থেকে বেশ কয়েক হাজার রোহিঙ্গার একটি দল বাংলাদেশ অভিমূখে রওনা দিয়েছে। আবার শুনলাম তারা নাকি মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়াতে আটকে পড়েছে। আজও এমনটি জেনেছি। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু একবার মানবিকতা দেখিয়েছে সেহেতু কেউ সীমান্ত অতিক্রম করলে তাকে নিয়মানুসারে ক্যাম্পে নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ সীমান্তে কাউকে পাওয়া গেলে সেখানেই মানবিক সহায়তা দেয়া হয়। বিজিবির পাশাপাশি সীমান্তে আইএনজিও এবং স্থানীয় এনজিওর প্রতিনিধিরা এসব রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা দেয়। বিজিবি কর্মকর্তা ইকবাল আরো বলেন, যারা নতুন করে ঢুকছেন তাদের পালিয়ে আসার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়। তারা খাদ্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য প্রাপ্তিতে অবরোধ এবং তাদের রোপিত ধান পাকার পর সেনারা কেটে নেয়ার কথাটি উল্লেখ করেছেন। তাদের শারীরিক অবস্থা এবং মুখাবয়ব দেখে তাদের কথাটাই সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড হওয়া সেদেশে সীমান্তরক্ষী ও আইনপ্রয়োগকারীরা ধান কাটছে এমনসব চিত্রও তারা দেখিয়েছেন। এদিকে, কুতুপালং রাবারবাগান এলাকার ডি-২ ব্লকের অবস্থান নেয়া বুচিদং লংদুমার বাসিন্দা গুরা মিয়া (৫৬) জানান, প্রতি বছরের মতো ১০ কানি (চার একর) জমিতে ধান লাগানো হয়েছিল। নিপীড়নের সময় হাঁটাহাঁটিতে কিছু ধান নষ্ট হয়। বাকিগুলো এখন পাকলেও কাটতে নামতে পারিনি। মিয়ানমার সেনা ও পুলিশ তা কেটে নিচ্ছে। এছাড়াও প্রায় ৫ শতাধিক আকাশমনি গাছ লাগানো একটি বাগানছিল। সেসব গাছও তারা সম্প্রতি কেটে নিয়ে গেছে। চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই বলতে পারিনি। তাই মনের দুঃখে সব ছেড়ে পরিবার পরিজন নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসি। শুক্রবার এ এলাকায় থাকার জায়গা হয়েছে। মংডুর নেছাপ্রু এলাকার বাসিন্দা কুতুপালং রাবারবাগান এ-১/বি-২ ব্লকে অবস্থানকারী আবদুল খালেক (৩০) বলেন, ২ একর ধান, দশটি ছোট-বড় গরু, নয় লাখ কিয়াত (মিয়ানমারের মুদ্রা) দামের একটি মোটরসাইকেল, প্রায় ত্রিশ মণ চাল, ৫ লাখ কিয়াত দামের মাছ ধরার বড় জাল এবং ৬০ শতক জমির সবজি চোখের সামনেই মিয়ানমার সেনারা নিয়ে গেছে। এ ছাড়াও এলাকার ১৫-২০ জন তরুণীকে তুলে নিয়ে কয়েকদিন ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে ছেড়ে দেয়। এসব চোখের সামনে ঘটলেও কোনো প্রতিবাদই করা সম্ভব হয়নি। ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে গত শুক্রবার ভিনদেশে আশ্রয় নিয়েছি।
নতুন আসা রোহিঙ্গারা আরো জানান, রক্তাক্ত নিপীড়ন বন্ধ হওয়ায় যারা ধান ও অন্যান্য পণ্য রক্ষা করতে পারা যাবে ভেবে থেকে গিয়েছিল তারা এখন চোখের জলে সব ধুয়ে বাংলাদেশে চলে আসছে। অপরদিকে, অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় ৩০ হাজার এবং গত শুক্রবার প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া এবং আরো আসছে জেনে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সীমান্ত ইউনিয়ন পালংখালী ইউপি’র প্যানেল চেয়ারম্যান নুরুল আবছার চৌধুরী। তার মতে, পুরোনো এবং চলমান আরাকান সংকট মিলিয়ে প্রায় দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছে। এ সংখ্যা সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ-উখিয়ার স্থানীয় জনগণের চেয়ে অধিক। এখানে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের খাবার, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশনসহ প্রয়োজনীয় অন্য সুবিধা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছি আমরা।
রোহিঙ্গাদের কারণে পাহাড়গুলো দখল হয়ে গেছে। সাবাড় হচ্ছে গাছপালা। অভয়ারণ্য হারাচ্ছে বন্যপ্রাণী। ফলে হাতিরপালের আক্রমণে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। এসব মৃত্যু সরকারের জন্য বিব্রতকর। এটা ছাড়াও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক এবং নিষিদ্ধ বস্তু আসছে। ইতিমধ্যে অনেকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে অনেক রোহিঙ্গা অস্ত্র, বোমা ও ইয়াবাসহ আটক হয়েছে। মানবিকতার সুযোগে তারা আমাদের আর্তসামাজিক পরিবেশ বিষিয়ে তুলছে।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি