২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৬:১৫

উখিয়া-টেকনাফের নিম্নআয়ের মানুষ গুলো বেকারত্বে দিশেহারা

উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি :

উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় ২ লাখ এবং ৫ লাখ অনিবন্ধিত পুরাতন রোহিঙ্গার এখন কোন কাজ নেই। ফলে নিম্নআয়ের মানুষ গুলো বেকারত্বে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছে না স্থানীয় দরিদ্র জনগোষ্টি। অপর দিকে নিবন্ধিত নয় বলে পুরাতন রোহিঙ্গারাও বঞ্চিত ত্রাণ সুবিধা থেকে। পরিচয় পত্র নেই বলে প্রায় দু’মাস ধরে ক্যাম্প থেকে বেরোতে পারছে না। ফলে নিদারুণ অভাব-অনটনের মধ্যে রয়েছে এ দুই উপজেলার মানুষ গুলো। এদের অভাব ও বেকারত্ব দূরীকরণে আপাতত সরকারের কোন পরিকল্পনা রয়েছে কিনা তাও জানেন না সংশ্লিষ্টরা। তবে স্থানীয় বাসিন্দাসহ যারা বেকার হয়ে পড়েছেন, তাদের জন্য দ্রুত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির দাবি জানিয়েছেন এলাকার জনপ্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝিরা। সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের মোট জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ। এদের মধ্যে দুই লাখই নিম্নআয়ের। সাধারণ কৃষি ও কৃষিনির্ভর কাজ, কাটমিস্ত্রী, রাজমিস্ত্রী ও দিনমজুরীর কাজই এদের প্রধান পেশা। অন্যদিকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নতুন-পুরাতন রোহিঙ্গাদের বসবাসও এই দুই উপজেলায়। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসেব মতে, তাদের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এর মধ্যে পুরাতন রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ। কিন্তু উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের লেদা রেজিষ্ট্রার্ড ক্যাম্পে শরণার্থী পরিচয়ে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা মাত্র ৩২ হাজারের মতো। এদের মধ্যে ১৪ হাজার রয়েছে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে এবং ১৮ হাজার রয়েছে টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে। কুতুপালং ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত অতীতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকৃত রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়নি। নতুন করে ২৫ আগস্ট হতে এ পর্যন্ত যারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে, তাদের নিবন্ধন হচ্ছে উখিয়া-টেকনাফের ৭টি নিবন্ধন বুথে। এদিকে কুতুপালং অস্থায়ী ক্যাম্পের ডি-৫ ব্লকের পুরাতন রোহিঙ্গা মো: জাকির (৫০) জানান, প্রায় ৫ বছর আগে মিয়ানমারের বুচিদংয়ের ফকিরা বাজার থেকে পরিবারের ৭ সদস্যকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। আত্মীয়তার সূত্র ধরে সেই থেকে আশ্রয় নেন কুতুপালং রেজিষ্ট্রার্ড ক্যাম্প এলাকার ডি-৫ ব্লকে। আগে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চকরিয়া, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালীসহ বিভিন্ন উপজেলায় কৃষিনির্ভর কাজ ও দিন মজুরী করে আয় রোজগার করতেন। নিয়মিত-অনিয়মিত যা আয় হতো তা দিয়ে চলতো তার সংসার। কিন্তু ২৫ আগস্ট হতে নতুন করে রোহিঙ্গার ঢল নামলে পুরাতনদের উপর কড়া নজরদারি ও বিভিন্ন নিয়ম শুরু হয়। নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়নি বলে আগে থেকেই তারা কোন ত্রাণসহায়তা পেতেন না। এখন কাজ করে আয় করার যে সুযোগটুকু ছিল সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কোন কাজও করতে দিচ্ছে না, ত্রাণ-সাহায্যে দিচ্ছে না কেউ। প্রায় দুইমাস বেকার থাকার পর দুইদিন ধরে ক্যাম্পের ভিতরে রাস্তার মাটি কাটার কাজ পেয়েছি মাত্র ৪২ জন। কাজের জন্য ক্যাম্পের বাইরে গেলে নিবন্ধন কার্ড না থাকায় এখন ক্যাম্পেও ঢুকতে দেয় না আইনের লোকেরা। আমরা বড়ই কষ্টে আছি পরিবার-পরিজন নিয়ে। পারলে কিছু করেন।’ এই আকুতি শুধু জাকিরের নয়, একই কথা জানালেন পুরাতন রোহিঙ্গা সোলতান আহমদ, মোহাম্মদ হোসেন, মোহাম্মদ ইসলাম, মোহাম্মদ জোবায়ের, রহিমা খাতুনসহ অনন্ত ২৫ জন। কেউ কেউ জানালেন, তাদের এখন আয়ের একমাত্র পথ পাহাড়ের গহীন জঙ্গলে গিয়ে গাছ কেটে লাকড়ি বানিয়ে বিক্রি করা। এতে অনেক সময় কারো কারো ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়। তবে ৫ লাখ বেকার রোহিঙ্গাদের মধ্যে এরকম কাঠুরিয়ার সংখ্যা নিতান্তই কম। পুরাতন রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে কুতুপালং ক্যাম্প ইনচার্জ (উপ-সচিব) রেজাউল করিম পুরাতনদের বিষয়ে এখনও কোন সরকারি নীতিমালা হয়নি। পরে হয়তো তাদেরও নিবন্ধন এবং ত্রাণ সহায়তার আওতায় আনা হবে। তারা অভাবে আছেÑএটা ঠিক। কিন্তু আমাদের তো ক্যাম্পের নিয়মের বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই। এদিকে নিজের এলাকায় সংখ্যালঘু হয়ে পড়া উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারাও পড়েছেন বেকায়দায়। রোহিঙ্গারা আসার ফলে তাদের আয়ের সুযোগ কমে গিয়েছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসায় বেকার হয়ে পড়েছেন নিম্নআয়ের লোকেরা। রোহিঙ্গাদের ত্রাণ কার্যক্রমের সাথে স্থানীয় কিছু মজুর শ্রেণীর মানুষ শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত হলেও তা সংখ্যায় হাতেগোনা মাত্র। এর বাইরে বিশাল একটি প্রান্তিক শ্রমগোষ্ঠী এখন কাজের অভাবে বেকার হয়ে পড়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন পাহাড়ী বনভূমিতে আশ্রয় নেওয়ায় তারা এখানকার শ্রমবাজারে নিজেদের যুক্ত করায় স্থানীয়দের কাজের সুযোগ কমে এসেছে। রোহিঙ্গাদের প্রভাবে দিন মজুরীর কাজে পারিশ্রমিকের হারও আগের চেয়ে কমে গেছে বলে জানান স্থানীয়রা। আগে বিভিন্ন রকম কাজ জুটতো আমাদের। এখন কাজ কমে গেছে, মানুষ বেড়ে গেছে। রোহিঙ্গারা আসার কারণে আমাদের আয়-রোজগারও কমে গেছে। কিন্তু বাজারে জিনিষ পত্রের দাম বেড়ে গেছে দ্বিগুণেরও বেশি এমনটি জানিয়েছেন কোটবাজারের বাসিন্দা ফজল আহমদের। স্থানীয় পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘স্থানীয় মজুর শ্রেণীর মানুষ আগে যে কাজের সুযোগ পেত, এখন সে সুযোগ নেই। স্থানীয়দের কাজে ভাগ বসাচ্ছে রোহিঙ্গারা। এলাকার কারো কারো ঘরে ভীষণ টানাপোড়েন চলছে। অভাবে-অনটনে দিন কাটাচ্ছে অনেকে। অভাবগ্রস্থ এই লোকগুলোর জন্য সরকারের দ্রুত কোন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করি।

দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :নভেম্বর ৫, ২০১৭ ৭:০৪ অপরাহ্ণ