২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৫:০৫

রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হবে: সুষমা স্বরাজ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিলেই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে বলে মনে করে ভারত। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন দিল্লি। ভারত সংকট নিরসনে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন চায়। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ‘জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশন’র (জেসিসি) বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এসব কথা বলেন। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার প্রতি এভাবেই ভারত সুস্পষ্ট সমর্থন ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশ অবশ্য রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
জেসিসি বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে কানেকটিভিটির ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। এক্ষেত্রে, কানেকটিভিটি বাড়াতে বাংলাদেশ একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়েছে। ভারত এসব প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদ দমনে বাংলাদেশ ও ভারত একসঙ্গে লড়াই করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। ভারত থেকে বাংলাদেশ বর্তমানে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে। ত্রিপুরা থেকে আরও ৩৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবে ভারত রাজি হয়েছে।
জেসিসি বৈঠকের পর বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সামর্থ্য বাড়ানো এবং ভারতের রুমালিগড় থেকে ডিজেল আমদানির ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত দুটি চুক্তি সই হয়েছে। এছাড়াও, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সোলার অ্যালায়েন্স অনুসমর্থনের দলিল ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে। একই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথের রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ১২ লাখ ৪০ হাজার ডলারের চেক বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছে ভারত। বৈঠকে অন্যদের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ও বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের পর দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের সামনে পৃথক বিবৃতি পাঠ করে শোনান।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বিশেষ বিমানে ২ দিনের সফরে রোববার ঢাকায় পৌঁছান। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে হোটেল সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চতুর্থ জেসিসি বৈঠক বসে। বৈঠকে যৌথভাবে সভাপতিত্ব করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সোনারগাঁও হোটেলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গেও সুষমা স্বরাজের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তারপর একই স্থানে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। আজ সকালে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের নতুন চ্যান্সারি ভবনের উদ্বোধন করবেন সুষমা স্বরাজ। এছাড়াও, নতুন ১৫টি প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
জেসিসি বৈঠকের পর পাঠ করা বিবৃতিতে সুষমা স্বরাজ বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় ভারত গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, সহিষ্ণুতার সঙ্গে জনগণের কল্যাণের দিকটি বিবেচনায় নিয়ে কাজ করা উচিত। এটা স্পষ্ট যে, বাস্তুচ্যুত লোকদের রাখাইন রাজ্যে ফেরত নিলেই শুধু স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে পারে। আমাদের অভিমত হল, রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে ওই রাজ্যে বসবাসরত সব সম্প্রদায়ের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমরা কফি আনান নেতৃত্বাধীন কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নকে সমর্থন করি।’ তিনি বলেন, ‘সেপ্টেম্বরে অপারেশন ইনসানিয়াতের মাধ্যমে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা লাখো বাস্তুচ্যুত মানুষকে কক্সবাজারে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ সরকার যে প্রশংসনীয় কাজ করেছে তার প্রতি আমরা সমর্থন দিয়েছি। এ অপারেশনের মাধ্যমে আমরা তিন লাখ মানুষকে সহয়তা দেয়ার জন্য চাল, ডাল, লবণ, চিনি, ভোজ্যতেল, গুঁড়াদুধ, মশারি ও সাবান সরবরাহ করেছি। বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে আমরা এসব সামগ্রী বিতরণ করেছি।’
রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেছেন, ‘বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মানবিক বিষয়ে ভারত সমর্থন দেবে বলে পুনরায় প্রতিশ্রুতি দেয়ায় আমরা খুশি। রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দেয়ায় আমরা ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। রোহিঙ্গারা যাতে টেকসই উপায়ে তাদের বসতবাড়িতে ফিরে যেতে পারেন সেই লক্ষ্যসহ রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে ভারতের প্রতি পুনরায় আহ্বান জানানো হয়।’ জেসিসি বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেছেন, ‘তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন ইস্যু নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি।’ মাহমুদ আলী এ সময় স্মরণ করিয়ে দেন যে, ৮ এপ্রিল দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মোদির এ আমলেই তিস্তা চুক্তি সই হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী এ সময় গঙ্গার পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের বিষয়ে ভারতের কারিগরি সমর্থন কামনা করেন। তিস্তা চুক্তির বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছুই বলেননি সুষমা স্বরাজ। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ তিস্তা চুক্তির নাম উল্লেখ না করলেও এটা বলেছেন যে, ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতির আলোচনায় আমরা অবশ্যই অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর ব্যাপারে সজাগ। আমরা আপনাদের এ নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, আমরা এসব অমীমাংসিত ইস্যু নিষ্পত্তি করতে কাজ করছি।’
জেসিসি বৈঠকে মাহমুদ আলী কানেকটিভিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতির কথা জানিয়ে বলেছেন, কানেকটিভিটির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। ভারত এসব প্রস্তাবের পক্ষে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। সড়ক, রেল ও পানিপথে এসব কানেকটিভিটি জোরদারের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের দেয়া প্রস্তাবগুলোর মধ্যে আছে- ঢাকা-চেন্নাই-কলম্বো এয়ার কানেকটিভিটি, চট্টগ্রাম-কলকাতা-কলম্বো শিপিং কানেকটিভিটি, পঞ্চগড়-শিলিগুড়ি রেল সংযোগ, ভারতের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে ভুটানের সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ এবং বাংলাদেশের নকুয়াগাঁও স্থলবন্দর থেকে ভারতের দালু হয়ে ভুটানের গেলিফুং পর্যন্ত বাণিজ্য কানেকটিভিটি। বিবিআইএন কানেকটিভিটির ক্ষেত্রে ভুটানকে বাদ রেখেই আপাতত বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের (বিআইএন) মধ্যে উপ-আঞ্চলিক কানেকটিভিটি চালু হবে বলে মাহমুদ আলী জানিয়ে বলেন, তারপর ভুটান তাতে যোগ দেবে। এছাড়াও বাংলাদেশ, ভারত ও ভুটানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় জলবিদ্যুৎ চুক্তি শিগগিরই সই হবে। নেপালের জলবিদ্যুৎ থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে সহযোগিতায় ভারত রাজি হয়েছে।
কানেকটিভিটির প্রশ্নে সুষমা স্বরাজ ১৯৬৫ সালের পূর্বে রেল, সড়ক, পানি ও উপকূলীয় পথে কানেকটিভিটি পুনরায় চালুর কথা বলেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এসবের মাধ্যমে আমাদের দুই দেশের জনগণ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছে। ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেসের চলাচলের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। মৈত্রী এক্সপ্রেসের কাস্টমস সেবা সহজ করা এবং কলকাতা-খুলনা বন্ধন সার্ভিস দ্রুত চালু হবে। আমাদের দুই দেশের নগরগুলোর মধ্যে অধিক বাস সার্ভিস শুরু হয়েছে। সীমান্তে আরও অনেক ইমিগ্রেশন চেক পয়েন্ট চালু করা হয়েছে। এসবই হল আমাদের সাফল্যের গল্পের কয়েকটি।
জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনের ব্যাপারে উভয় দেশ ‘জিরো’ টলারেন্স দেখানোর কথা বলেছে। মাহমুদ আলী বলেন, ‘আমরা আমাদের ভূমি পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেব না’। এ বিষয়ে সুষমা স্বরাজ বলেছেন, ‘আমরা যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছি সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এসব চ্যালেঞ্জের একটি হল- সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদ যার বিরুদ্ধে আমরা একসঙ্গে লড়াই করব। ঘৃণা, সহিংসতা ও সন্ত্রাসের কবল থেকে আমরা আমাদের পরস্পরের ভূখণ্ডকে সুরক্ষা দেব।
ভারতের ঋণে বাংলাদেশে অবকাঠামো প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনার কথা উল্লেখ করেন সুষমা স্বরাজ বলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে আটশ’ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ভারত। এটা কোনো একক দেশকে ভারতের দেয়া সর্বোচ্চ ঋণ। এসব ঋণে গত ৩ বছরে ২৪টি বড় বড় প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে। রাজশাহী, খুলনা, সিলেট নগর উন্নয়নসহ ৫৮টি প্রকল্প হাতে রয়েছে। সোমবার ১৫টি প্রকল্প উদ্বোধন করা হবে। জনগণ পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করে সুষমা স্বরাজ বলেন, ২০১৬ সালে ৯ লাখ ৭৬ হাজার বাংলাদেশিকে ভারতীয় ভিসা দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে ১৪ লাখ বাংলাদেশিকে ভিসা দেয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি
প্রকাশ :অক্টোবর ২৩, ২০১৭ ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ