২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৬:৫৯

বাংলাদেশের বন্ধু ফাদার মারিনো রিগন আর নেই

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিক ও মুক্তিযোদ্ধা ফাদার মারিনো রিগন আর নেই। ইতালির ভিচেঞ্চায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় না ফেরার দেশে চলে যান তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। ফাদার রিগন দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন।

১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভেনিসের অদূরে ভিচেন্সার ভিল্লা-ভেরলা গ্রামে জন্মগ্রহণকারী খ্রিস্টান ধর্মযাজক মারিনো রিগন প্রায় ৬০ বছর ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করেছেন। এই ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারক ২৬ বছর বয়সে ফাদার পদে অভিষিক্ত হওয়ার দুই বছর পর ১৯৫৩ সালের ৭ জানুয়ারি কলকাতা হয়ে বেনাপোল সীমান্তপথে বাংলাদেশে আসেন। সেই থেকে পাঁচ যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ধর্ম প্রচার করেছেন তিনি। স্থায়ীভাবে আবাস গেড়েছিলেন সমুদ্রবন্দর মংলা পৌর এলাকার শেলাবুনিয়ায়। সেখানে তিনি গড়ে তুলেছেন সাধুপলের গীর্জা। ২০১৪ সালে অসুস্থতার কারণে ফিরে যান নিজ জন্মস্থানে, আপজনদের কাছে।

ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশের মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার প্রসার, চিকিৎসা সেবা ও দুঃস্থ নারীদের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি অসুস্থ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সেবা দেওয়ার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করে।

বাংলা শিল্প-সাহিত্য নিয়ে গবেষণার পর তা ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন ফাদার মারিনো রিগন। তার হাত দিয়ে ইতালীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলিসহ প্রায় ৪০টি কাব্যগ্রন্থ, লালন সাঁইয়ের ৩৫০টি গান, জসীম উদদীনের নকশীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট ছাড়াও এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের অনেক কবিতা।

ফাদার রিগনের ইতালীয় ভাষায় অনূদিত রবীন্দ্রকাব্যের একাধিক গ্রন্থ ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ ও পুর্তগিজ ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯৯০ সালে তিনি ইতালিতে রবীন্দ্র অধ্যয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ফাদার রিগন বাংলার নকশিকাঁথাকেও তুলে ধরেছেন ইতালির বিভিন্ন শহরে। তার প্রতিষ্ঠিত শেলাবুনিয়া সেলাই কেন্দ্রের উৎপাদিত নকশিকাঁথার চারটি প্রদর্শনী হয় ইতালির বিভিন্ন শহরে।

ফাদার রিগনের কর্মপরিধির বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে শিক্ষামূলক কার্যক্রম। তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য তিনি বৃত্তির ব্যবস্থাও করেছিলেন।

১৯৮৬ সালে ফাদার রিগনের সহযোগিতায় বাংলাদেশের একটি নৃত্যনাট্যের দল ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ মঞ্চায়ন করে ইতালির বিভিন্ন মঞ্চে। বিপদকে পায়ে ঠেলে যিনি বা যারা আক্রান্তের পাশে দাঁড়ান জীবনকে তুচ্ছ ভেবে, তাদেরই বলা যায় দুর্দিনের সুহূদ।

মুক্তিযুদ্ধকালে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এমনই কিছু মানুষের অবদান বর্তমান প্রজন্ম তথা দেশের অনেকের কাছে থেকে গেছে অজানা। সেই দুর্দিনে এমন এমন কেউ নীরবে-নিভৃতে সাহসিকতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে এক বা একাধিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যা হতে পারে ইতিহাসের এক গৌরবময় উপাখ্যান।

এমনই প্রায় অজানা এক মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় গোপালগঞ্জের বানিয়ারচর গীর্জায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও আশ্রয়ের সন্ধানে পথচলা মানুষকে চিকিৎসা সেবা ও খাবার দিয়ে সাহায্য করেছেন। আত্মপ্রচার বিমুখ এ মানুষটির কথা জেনে বঙ্গবন্ধু তাকে গণভবনে দেখা করতে বললে পল্লীকবি জসিমউদ্দিন ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন গণভবনে নিয়ে যান তাকে। এক ঘণ্টার এ সাক্ষাতে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু তার প্রশংসা করেন এবং ধন্যবাদ জানান। নিজের ও সহকর্মীদের জীবন বাজি রেখে যে কজন বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশের ভেতরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন তাদের একজন হচ্ছেন ফাদার মারিনো রিগন।

ইতালীয় বংশোদ্ভুত বানিয়ারচর খ্রিস্টান মিশনের এই ধর্মযাজক ১৯৭১ সালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ফরিদপুর অঞ্চলের সাব সেক্টর কমান্ডার হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রমসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। হাজার হাজার শরণার্থী ও বহু মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়েছেন আশ্রয়,  ট্রানজিট সুবিধা ও খাদ্য। এভাবেই নানা কৌশলে জীবনের মায়া ত্যাগ করে এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, নড়াইল, বাগেরহাট ও বরিশাল অঞ্চলের যুদ্ধাহতদের আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসা সেবায় ফাদার রিগন অবদান রেখে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের একজন সহযোদ্ধা।

দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ

 

প্রকাশ :অক্টোবর ২১, ২০১৭ ২:০৬ অপরাহ্ণ