নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিনিয়োগ মন্দা, ব্যাংকে বাড়ছে অলস টাকা। খরচ কমাতে সুদের হার টেনে ধরেছে ব্যাংকগুলো। ফলে সুদের হার কমতে কমতে একেবারে তলানিতে নেমেছে। এরই ধারাবাহিকতায় পাঁচ বছরে ব্যাংকিং খাতে আমানতের সুদের হার কমেছে ৪২ শতাংশ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হওয়ায় ব্যাংকিং খাতে পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় ঋণের চাহিদা কম। বিনিয়োগ না বাড়ায় আমানত নিয়ে এ অর্থের সুদ দিতে রাজি নয় ব্যাংকগুলো। এ কারণে নতুন আমানত সংগ্রহে আগ্রহ কম। ফলে পরিচালন ব্যয় ও মুনাফা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ধারাবাহিকভাবে কমানো হচ্ছে আমানতের সুদ বা মুনাফার হার। তবে আমানতের সুদের হার সার্বিক মূল্যস্ফীতির ওপরে রাখা উচিত, বলছেন সংশ্লিষ্টরা। আর সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার নির্দেশনা দিয়েছে ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ (আগস্ট) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকিং খাতে সার্বিক আমানতের সুদের হার চার দশমিক ৯৩ শতংশ। এর বিপরীতে ঋণ সুদের হার দাঁড়িয়েছে নয় দশমিক ৪৬ শতাংশ। এদিকে ২০১৩ সালে একই সময়ে আমানতের সুদের হার আট দশমিক ৫৫ শতংশ। সেই হিসেবে পাঁচ বছরে আমানতরে সুদের হার কমেছে তিন দশমিক ৬২ শতাংশীয় পয়েন্ট বা ৪২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৩ সালের পর থেকে আমানতের সুদের হার ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০১৩ সালের আগস্টে আমানতের গড় সুদের হার ছিল আট দশমিক ৫৫ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা নেমে আসে সাত দশমিক ৬৩ শতাংশীয় পয়েন্টে। পরের ২০১৫ সালে দাঁড়ায় ছয় দশমিক ৭৪ শতাংশীয় পয়েন্টে, ২০১৬ সালে পাঁচ দশমিক ৪৪ শতাংশীয় পয়েন্ট এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগস্টে গড় আমানতের সুদের হার চার দশমিক ৯৩ শতাংশীয় পয়েন্টে। অর্থাৎ বর্তমানে ব্যাংকে ১০০ টাকা আমানত রাখলে গড়ে চার টাকা ৯৩ পয়সা সুদ বা মুনাফা পাওয়া পায়। তবে সার্বিক আমানতের হার চার শতাংশের ওপরে থাকলেও অনেক ব্যাংক এক-দুই শতাংশ সুদ বা মুনাফা দিচ্ছে আমানতকারীদের।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমানতের মুনাফা দিয়ে অনেকে জীবনযাত্রার ব্যয় বহন করে থাকে। তাই আমানতের সুদের হার কোনো মতেই মূল্যস্ফীতির নিচে থাকা উচিত নয়। এতে করে একদিকে ব্যাংকে টাকা রাখলে তা কমে যায়। অন্যদিকে ব্যয় বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, ঋণের সুদের হার কমাতে আমানতের হার কমানো হয়, এটা স্বাভাবিক। তবে আমানতের সুদ পাঁচ শতাংশের নিচে নামিয়ে ঋণের সুদ কমানোর কোনো যুক্তি হতে পারে না। ঋণের সুদ কমানোর জন্য স্প্রেড (আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান) কমানো দরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, স্প্রেড হার পাঁচ শতাংশীয় পয়েন্ট। তা কমিয়ে তিন থেকে চার শতাংশ নামিয়ে আনা উচিত। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলো যোগসাজশে আমানত হার কমাচ্ছে কি না, তাও খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক এ গভর্নর।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসেব অনযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ছয় দশমিক ১২ শতাংশ। সেই হিসেবে মূল্যস্ফীতি থেকে আমানতের হার এক দশমিক ১৯ শতাংশ কম। অর্থাৎ ব্যাংকে টাকা রাখলে আমানতকারীদের লাভ নয় উল্টো লোকসান হচ্ছে।
এদিকে অপচয়মূলক ভোগ ও অনুৎপাদনশীল খাতে অর্থ ব্যয় রোধে আমানত ও ঋণের সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার নির্দেশনা নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের মতে, আমানতের সুদ বা মুনাফার হার পাঁচ শতাংশের নিচে থাকলে সঞ্চয় প্রবণতাকে ক্ষুণ্ন করছে। একই সঙ্গে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে যা বাঞ্ছনীয় নয়।
গভর্নর ফজলে কবির সম্প্রতি তফসিলি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে ব্যাংকার্স সভায় সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি ও মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকিং খাতে অলস টাকা পড়ে আছে। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খুব একটা ভালো না। শেয়ারবাজারেও ব্যাংকের বিনিয়োগের একটি নির্ধারিত সীমা রয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের জায়গা না থাকায় আমানত হার কমিয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে মূল্যস্ফীতির নিচে আমানতের হার রয়েছে। যা কাম্য নয়। এখন মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণে আমানতকারীদের ওপর চাপ আরও বেশি বাড়ছে।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ