নিজস্ব প্রতিবেদক:
বসত-ভিটা না থাকলে রিলিফ দিয়া কী করমু। আমাগো প্যাটে খাইবার নিগা চাল-ডাল দরকার নাই, রাক্ষুসী যমুনার প্যাটে (গর্ভে) বালির বস্তা ও সিমেন্টের বোল্ডার দাও (নিক্ষেপ)। নদীডা ঠেকাও, এলাকা বাঁচাও। কথাগুলো এভাবেই অশান্ত মনের যন্ত্রণা প্রকাশ করলেন ব্রাহ্মণগ্রামে নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত দিনমুজুর মোফাচ্ছেলের স্ত্রী আনোয়ারা খাতুন (৪১)। আনোয়ারার বসত-ভিটা বুধবার ভোরে নদীতে দেবে গেছে, চার সন্তান নিয়ে খোলা আকাশের নিচে খেয়ে না খেয়ে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছেন।
বৃহস্পতিবার বিকেলের দিকে সিরাজগঞ্জের তাঁত শিল্প সমৃদ্ধ এনায়েতপুর থানার ব্রাহ্মণগ্রাম থেকে পাচিল পর্যন্ত যমুনার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে ৫ কিলোমিটার এলাকা পরিদর্শনে এসে এলাকাবাসীর দাবির মুখেও নদী তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ শুরুর বিষয়ে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা না পেয়ে স্থানীয় ইউপি’র দেয়া ত্রাণ পেয়ে আনোয়ারার মতো অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন, যমুনা বাড়ি ঘর সব গ্রাস করেছে। নদী ভাঙন ঠেকানোর কাজ শুরু না করে ১০ কেজি চাল দিলেন। যা দুই দিন খাইলে ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে এখন কোথায় থাকব? বাড়িতে ডাকাতি করলে কিংবা আগুনে পুড়লে কিছু সম্পদ থাকে কিন্তু যমুনায় বাড়ি ভাঙলে পথের ফকির হতে হয়।
সরেজমিন জানা যায়, গত তিন সপ্তাহে ভাঙ্গনের কবলে পরে ব্রাহ্মণগ্রাম, আড়কান্দি, ঘাটাবাড়ি, পাকুরতলা, কুঠিপাড়া, ভেকা ও পাচিল গ্রামের তিন শতাধিক ঘর-বাড়ি ও কয়েকশ একর আবাদি জমি। এছাড়া হাট বয়ড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বসন্তপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ ব্রাহ্মণগ্রাম ও আড়কান্দি চরের বেশ কয়েকটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলে গেছে নদীর পেটে। হুমকির প্রায় ২০ হাজার ঘরবাড়ি, বহু তাঁত কারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
এদিকে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে এক সময়ের পাকা বসতভিটা ও জমি-জমাসহ বিপুল বিত্তের মালিকরা এখন হয়েছে ভুমিহীন। এদের অধিকাংশই খোলা আকাশের নিচে কাগজ টাঙ্গিয়ে বসবাস করছে। আবার কেউ আশ্রয় নিয়েছে ওয়াবদাবাঁধে অথবা অন্যের বাড়িতে। তবে এদের অধিকাংশের পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষমদের কাজকর্ম ফেলে ঘর-বাড়ি সরানোর কাজ করতে হচ্ছে। একাজে সহযোগিতা করতে গিয়ে স্কুলগামী ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। সবমিলে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তরা। তারপরও ত্রাণের জন্য কারো আক্ষেপ নেই, সবার প্রাণের দাবি যমুনা পশ্চিম তীর রক্ষায় দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হোক।
এদিকে নদী ভাঙনে বসত বাড়ি হারানো আড়কান্দি চরের আব্দুল হালিম ও সাহেদুল ইসলাম জানান, চোখের সামনে সব নদীতে যাচ্ছে। তিলে তিলে গড়ে তোলা বসতভিটা মুহূর্তের মধ্যে নদী গর্ভে যাবার দৃশ্য দেখে চোখের পানি ফেলা ছাড়া কিছু করার নেই। পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বাঁধ নির্মাণে দীর্ঘ মেয়াদী সময়সীমার আশ্বাসের কথা শুনে আমরা হতাশ। আর কতো ঘরবাড়ি, ফসলি জমি নদীতে গেলে বাঁধ নির্মাণ হবে?
এছাড়া ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তরা ব্রাহ্মণগ্রামের মুকুল মুকুল হোসেন, হাসমত আলী ও জাকারিয়া হোসেন বলেন, আমরাতো অসহায় ছিলাম না, কিন্তু ভয়ংকার যমুনা আমাদের সব কেড়ে নিয়ে পথে বসিয়েছে। দয়া করে ত্রাণের বোঝা আমাদের মাথায় চাপিয়ে দেবেন না। নদী তীর রক্ষায় স্থায়ী বাঁধ চাই। বাঁধ নির্মাণ না করে নানা অজুহাত দেখিয়ে সময়ক্ষেপণের কারনে যমুনার অব্যাহত ভাঙন আরো শত শত বাড়ি ঘর গিলে খাবে। হুমকির মুখে পড়বে দেশের বৃহৎ কাপড়ের হাট ও এনায়েতপুর-পাচিল সড়কসহ দক্ষিণ জনপদ।
এ বিষয়ে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহেলী লায়লা বলেন, উপজেলার ব্রাহ্মণগ্রাম-আড়কান্দি থেকে পাচিল পর্যন্ত যমুনার ভাঙন এলাকা ইতোমধ্যে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী পরিদর্শন করেছেন। এলাকা রক্ষায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। আশা করছি পাউবোসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভাঙনরোধে যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ