নিজস্ব প্রতিবেদক:
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সামাজিক ব্যবসায়ই সুখী থাকার, জীবনকে উপভোগ করার একমাত্র উপায় বলে মনে করেন নোবেল জয়ী ড. মুহম্মদ ইউনুস। সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে তিনি একথা বলেন। নোবেল জয়ী ড. মুহম্মদ ইউনুস বলেন, দারিদ্র জনসাধারণের সৃষ্টি নয়। এটি আমাদের ব্যবস্থাপনার সৃষ্টি যা আমরা দাঁড় করিয়েছি। দরিদ্র জনগণ বনসাইয়ের মত। বনের সবচাইতে বড় গাছের বীজ এনে যদি ছোট্ট টবে রোপণ করা হয় এটি কয়েক মিটারের বেশি লম্বা হবে না। এতে বীজের কোন দোষ নেই। সমস্যা টবের। এই সমাজ দরিদ্র জনসাধারণকে কোন সুযোগ দেয় না। এটিই মূল কারণ।
বাংলাদেশ, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ফ্রান্স, হাইতি, ভারত, জাপান, উগান্ডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৃহৎ সংস্থাগুলোর সঙ্গে ইউনুস সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইউনুস বলেন, অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে সামাজিক ব্যবসায়ের ধারণা বিস্তার আবশ্যক যা মানবিক সমস্যাগুলোর সমাধানে নিবেদিত হয়ে কাজ করে। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে আমাদের লাভকে ব্যক্তিগতভাবে কেন্দ্রীভূত করার পরিকল্পনা ঝেড়ে ফেলতে হবে, অসমতার সমস্যা বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমাধান করতে পারবে না।
অক্সফামের প্রতিবেদনে আমি দেখেছি সারা বিশ্বের ৫০ ভাগ সম্পদই আট জন ব্যক্তির অধীনে, কয়েকদিন আগে পত্রিকায় দেখেছি এটি আট থেকে পাঁচে এসে দাঁড়িয়েছে। এক দু বছরের মধ্যে এটি দুই বা এক জনের মধ্যে চলে আসবে। এখানে দুইটি বিষয় উল্লেখযোগ্য প্রথমত, সম্পদের কেন্দ্রীয়করণ এবং এটি বৃদ্ধির প্রতি মনোযোগ।
পুঁজিবাদ ব্যবস্থাপনা সম্পদ নিচ থেকে উপরে তুলে দেয়। এটি উপরে থাকা ব্যক্তির দোষ নয়। সেটি সেই ব্যবস্থাপনার দোষ যা তারা অনুসরণ করে। এই ব্যবস্থায় সম্পদ হল চুম্বকের মত। যদি আপনার একটি ছোট চুম্বক থাকে তবে আপনি ছোটখাট সম্পদ অর্জন করতে পারবেন যদি আপনার বড় চুম্বক থাকে হবে আপনি আরো বেশি অর্জন করতে পারবেন। এবং এই সম্পদের মাশরুম এক সময় এ্যাটমিক মাশরুমের রুপ ধারণ করে। এটি আমাদের রাজনীতি, সমাজ এবং অর্থনীতিকে ধ্বংস করে। কারণ সম্পদকে কুক্ষিগত করা ক্ষমতার আসক্তির জন্ম দেয়। এর থেকে সর্বনিন্ম পর্যায়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই ক্ষোভ যে কোন বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। ব্রেক্সিট, মার্কিন নির্বাচন এবং জার্মান নির্বাচন এই ক্ষোভেরই প্রতিফলন।
সামাজিক ব্যবসা সম্পর্কে সাংবাদিক ডেভিড ব্রনস্টেইনের এক প্রশ্নের উত্তরে ইউনূস জানান, কানাডার কোম্পানি ম্যাককেইন ফুড আমাদের সঙ্গে সামাজিক ব্যবসায়ে যোগ দিল। তারা সারা বিশ্বে ৬০ শতাংশ ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বিক্রয় করে। আমরা যৌথভাবে কলম্বিয়ায় সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলি। কলম্বিয়ার কৃষকদের জীবনধারণ খুবই কষ্টের। আমরা তাদের আলু সহ মানসম্মত সবজি উৎপাদন করতে সাহায্য করি। এরপর আমরা ফ্রান্সে সামাজিক ব্যবসা শুরু করি। ফ্রান্সের ফ্রাই মেশিনের ভুল আকৃতির কারণে সেখানে ২৬ শতাংশ আলু নষ্ট হয়। ম্যাককেইন এখানে সম্ভাবনা খুঁজে পায় । তারা বেকার যুবকদের নিয়োগ করে এবং এই সব আলু দিয়ে আলুর স্যুপ তৈরি করে। একসময় তারা দেখতে পায় ইউরোপের সুপারমার্কেটগুলো পছন্দসই আকৃতির না হওয়ায় ৩০ শতাংশ সবজি ফেলে দেয়। তারা ওই সবজিগুলোকেও একই কাজে ব্যবহার করে। এটিই সামাজিক ব্যবসা। যদি তুমি ব্যক্তিগত লাভের আশা বাদ দিয়ে কোন সমস্যার সমাধান খোঁজ তবে তুমি সেখানে নতুন সম্ভাবনা দেখতে পাবে যা আগে কখনো দেখা যায় নি।
আর আমি মনে করি বিশ্বকে পরিবর্তন করতে তরুণ জনগোষ্ঠি হল ‘সেরা শক্তি’। তারা উদার মানসিকতার। তারা পুঁজিবাদি ব্যবস্থার মূলধারায় আবদ্ধ নয়। তারা প্রযুক্তি বোঝে। তারা কিছু করার চিন্তা করে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তরুণদের সামাজিক ব্যবসায়ের শিক্ষা দিচ্ছে। প্রতিটি ব্যবসায়িক শিক্ষা বিভাগের উচিত সাধারণ এমবিএ ’র পাশাপাশি সামাজিক এমবিএ কোর্স চালু করা।
যদি অর্থ উপার্জন সুখ ডেকে আনে তবে অন্যকে সুখের মুখ দেখানে অধিক সুখ ডেকে আনে। এটিই সামাজিক ব্যবসায়ের ধারণা। আমি আশা করি সারা বিশ্বের অর্থনীতির এক ভাগ সামাজিক ব্যবসায় পরিণত হবে। যদি এটি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে তবে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমি নিজে অনেক ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু বিশ্বের কোন কোম্পানিতে আমার একটিও অংশীদারিত্ব নেই। বিলিয়ন ডলার আয় করে কি হবে? বিশ্বের যে পাঁচজন ব্যক্তি সারা বিশ্বের সম্পদের ৫০ ভাগ ধারণ করে আছেন তাদের এই সম্পদ ৭৫০ মিলিয়ন মানুষের সম্পদের সমান। এই অর্থ দিয়ে কি করা হয়? খাওয়া? বাড়ি তৈরি করা? গান শোনা? উপভোগ? আমার কাছে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সামাজিক ব্যবসায়ই সুখী থাকার, জীবনকে উপভোগ করার একমাত্র উপায়।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ