২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সন্ধ্যা ৬:৫২

কোন এক সময়, ইতিহাসের সাথে, শশী লজে

দেশ জনতা ডেস্ক:

আপনাকে থমকে যেতে হবেই। সৌন্দর্যাঘাতে আপনি হা হয়ে গেলে আমি একটুও আশ্চর্য হব না। কারণ, আমারও তাই হয়েছিল। আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি, এতো বড় শ্বেত মার্বেল পাথরের ভেনাসের পূর্ণাঙ্গ মূর্তি দেশের আর কোথাও নেই। ১০০ বছরের বেশি সময় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিটি। এককালে এই মূর্তির পদযুগল স্নাত হতো জলের ফোয়ারায়। তবে মূর্তির ঠিক নিচ থেকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে এবং চারপাশ থেকে আলোক প্রক্ষেপণের ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে সেটি কাজ করে না।

কল্পলোকে ভাবুন, জল ফোয়ারা আছরে পড়ছে ভেনাসের পায়ে, চারপাশ থেকে নিখুঁতভাবে আলোকিত করা হয়েছে ভেনাসকে। আপনার কেমন লাগবে পুরো সন্ধ্যা এই অপূরূপ সৌন্দর্যে অবগাহন করতে?‘শশী লজ’(Soshi Lodge) ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মহারাজা শশীকান্ত আচার্যের বাড়ির নাম। স্থানীয়ভাবে এটি ময়মনসিংহ রাজবাড়ি নামেও পরিচিত। এ লজের অদূরে ব্রহ্মপুত্র নদ।

জমিদার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য ১৮ শতকের শেষার্ধে ‘ক্রিস্টাল প্যালেস’ নামে এক মনোরম প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, যা ‘রংমহল’ নামেও পরিচিত ছিল। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্পে এ প্রাসাদ ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯ শতকের একদম শুরুর দিকে মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য একই স্থানে বাইজেন্টাইন ধাঁচের নির্মাণ শৈলীতে শশী লজের নির্মাণ কাজ শুরু করেন।

ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই সূর্যকান্ত আচার্য মত্যুবরণ করেন। নিঃসন্তান সূর্যকান্তের দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য ১৯০৫ সালে এ ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। তার নাম অনুসারে এ ভবনের নামকরণ হয় ‘শশী লজ’। মহারাজ শশীকান্ত ১৯১১ সালে শশী লজের সৌন্দর্যবর্ধনে কিছু সংস্কার কাজ করে এ ভবনকে করে তোলেন অনিন্দ্যসুন্দর।

১৮টি বিশাল বিশাল ঘর নিয়ে শশী লজ। বারান্দা ও করিডোর নিয়ে ভবনটি ৫০,০০০ বর্গ ফুটের কম হবে না। পুরো ভবনের ফ্লোর মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত। ছাদে উঠার জন্য একটি কারুকাজ খচিত লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ি আছে। পুরো ভবনে রানিং ওয়াটারের লাইন টানা আছে। ভবনের ভেতরে আধুনিক টয়লেটও আছে। ভবনটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এর অনেক কিছুই এখনও নষ্ট হয়নি।

পেছনে রয়েছে পাড় বাঁধানো পুকুর। পুকুর পাড়ে হাওয়া খাওয়ার জন্য দ্বিতল ছোট্ট ভবন। সিঁড়িটা বেশ বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত। প্রতি তলায় দুই পাশে কমোড লাগানো ২টি করে টয়লেট। এখন আর কমোড নেই। কিন্তু পাইপ, পানির কলের লাইন, কমোডের লাইন এখনও আছে। পুকুরের বাঁধানো সিঁড়ির দুপাশ দিয়ে পুকুরের বেশ কিছুটা ভেতরে ২টি গোল স্তম্ভ। মার্বেল পাথরে মোড়া এ স্তম্ভ দেখে মনে হয় এককালে এখানে বসে গায়ে হাওয়া লাগানো হতো। পুকুর পাড়েই গোলাকৃতির একটি কাপড় পরিবর্তনের ঘর রয়েছে। লজের চারপাশে এখনও কিছু বিশদাকায় বৃক্ষ কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। সেই ১০০ বছরেরও অধিকাল আগের নির্মিত সীমানা প্রাচীর আজও প্রায় অটুট আছে।

এখানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের একজন কেয়ারটেকার নিয়োজিত আছেন। তবে তিনি ভুলভাল তথ্য দিয়ে আপনার মাথা খারাপ করে দিতে পারেন। কেয়ারটেকার বার বার বলেন, তারা ছিলেন খুবই নিষ্ঠুর কিন্তু খুবই সৌখিন।কথিত আছে এক সময় মুক্তাগাছার মণ্ডা শুধুমাত্র মহারাজাদের জন্য তৈরি হতো। রাজারা তাদের ভোজন অতিরিক্ত মণ্ডা নিজেরা ছাড়া কাউকে খেতে দিতেন না। অতিরিক্ত মণ্ডা প্রিয় দুই হাতি শঙ্খ ও সম্ভুকে খাওয়াতেন। শঙ্খ ও সম্ভুর আংশিক কংকাল শশী লজের অদূরে মোমেনশাই জাদুঘরে রাখা আছে। কেয়ারটেকার বার বার বলছিলেন, রাজাদের একি নিষ্ঠুর আচরণ! একটু দিলে কী এমন হতো? রাজাদের জন্য বানানো মণ্ডা না খেতে পাওয়ার অতৃপ্তি যেন তিনি বংশ পরম্পরায় বহন করছেন।সংস্কার কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভেতরে ঢোকার সুযোগ নেই। বাইরে থেকে দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। বিশেষ অনুরোধে আমরা মাত্র ২টা ঘর দেখতে পেরেছি।১৯৫২ সাল থেকে শশী লজ মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। গত মাস দুয়েক আগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর এ ভবনটি অধিগ্রহণ করেছে। ফান্ডের অভাবে এখনও সংস্কার কাজ শুরু হয়নি। শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র শশী লজ এর প্রায় অর্ধেক ফাঁকা জায়গা এখনও ব্যবহার করছে। সেটা সম্ভবত আর কখনোই শশী লজের হবে না। এখানে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি থাকলে কেউ কোনোদিন এই ভবনের পুরোপুরি সৌন্দর্য দেখতে পাবে না। যেভাবে যাবেন :ঢাকার যেখান থেকে ময়মনসিংহ যাবার বাস পাবেন, সেখান থেকেই বাসে উঠে ময়মনসিংহ শহরে নামবেন। (মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে এনা বাস যায়)। সেখান থেকে যেকোনো রিক্সা বা ইজি বাইকে শশী লজ বা ময়মনসিংহ রাজবাড়ি বলে দরদাম করে ভাড়া ঠিক করবেন। তারপর যাবেন।

n/h =ddj

প্রকাশ :মে ১৪, ২০১৭ ৮:১৭ অপরাহ্ণ