নিজস্ব প্রতিবেদক:
গণহত্যা ও নিপীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে। গত ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গাদের যে স্রোত শুরু হয়েছিল তা এখনো অব্যাহত আছে। জনস্রোতের মাত্রা কিছুটা কমলেও এখনো কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় প্রতিদিনই বাড়ছে শরণার্থীর সংখ্যা।
জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য মতে, গত ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে পাঁচ লাখ এক হাজার ৮০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। অনাহারে অর্ধাহারে থাকা এসব রোহিঙ্গা এখন বেঁচে আছে ত্রাণের ওপর। সরকারি-বেসরকারি ত্রাণের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আসছে বিপুল পরিমাণ ত্রাণ।
দুই-একটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ সবহারানো রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণের হাত প্রসারিত করেছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। তবে চীন মিয়ানমারের পক্ষ নিলেও ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ পাঠিয়েছে। চীন গত ২৭ সেপ্টেম্বর ৫৭ টন ত্রাণ পাঠায় দেশটি। প্রতিবেশী দেশ ভারত মিয়ানমারের পক্ষ নিলেও ত্রাণ পাঠিয়েছে। ভারতের হাইকমিশন বলেছে, সাতশ টন ত্রাণ পাঠাবে দেশটি। শুরু থেকেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে তৎপর পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, আজারবাইজানসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এসব দেশ রোহিঙ্গাদের সাহায্য সহযোগিতার জন্য বলেছে।
ত্রাণ কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে জাতিসংঘ। রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে বিবৃতি, বক্তব্য দেয়াসহ বড় ধরনের ত্রাণ তহবিল যোগাড়ের জন্য কাজ শুরু করেছে বিশ্বের প্রধান এ সংগঠনটি। ইতিমধ্যে সাত কোটি ৭০ লাখ ডলার তহবিল সংগ্রহের ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘ। গত ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফ শিশুদের জন্য ১০০ টন ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে কোপেনহেগেন থেকে একটি কার্গো বিমান ঢাকায় পৌঁছেছে। আগামী তিন মাসের জন্য ৭৩ লাখ ডলারের তহবিলের আহ্বান জানিয়েছে ইউনিসেফ। এদিকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিককে খাদ্য সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)।
মুসলিম দেশগুলোর শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তুরস্ক, ইরান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাত ত্রাণ পাঠিয়ে রোহিঙ্গাদের পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জাতিসংঘ সাত কোটি ৭০ লাখ ডলার, যুক্তরাষ্ট্র নয় কোটি ৫০ লাখ ডলার, যুক্তরাজ্য ২৫ মিলিয়ন পাউন্ড, সৌদি আরব দেড় কোটি ডলার, অস্ট্রেলিয়া ৫০ লাখ ডলার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) দেড়শ’ কোটি টাকা, নেদারল্যান্ডস পাঁচ কোটি টাকা, ডেনমার্ক ২৫ কোটি টাকা, কুয়েত দেড় মিলিয়ন ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া ১৫ লাখ ডলার অর্থ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া আরও কিছু দেশের ছোটখাটো সহায়তার ঘোষণা রয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতিশ্রুত এ সহায়তার পরিমাণ এক হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার কিছু বেশি। এর পাশাপাশি তুরস্ক, আজারবাইজান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মরক্কো, ইরান ও ভারতসহ কয়েকটি দেশ ও বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে নানান ধরনের ত্রাণসহ এক হাজার ২৪৬ টন ত্রাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চাল-আটা রয়েছে ২৭০ টন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সহিংসতার কারণে ১৯৭৮ সাল থেকে চলতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ১০ লাখ নয় হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। এর মধ্যে গত এক মাসেই এসেছে চার লাখ ২৪ হাজার। ২০১৬ সালের বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৮৭ হাজার এবং ২০১২ ও ২০১৩ সালে তিন থেকে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। সে হিসাবে চার বছরেই দেশে অনুপ্রবেশ করেছে ১০ লাখের বেশি মিয়ানমার নাগরিক।
১৯৯১-৯২ সালে দুই লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করলেও তাদের মধ্যে দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জনকে ফেরত পাঠানো হয়। মিয়ানমার সরকারের অনীহার কারণে ২০০৫ সালের ২৮ জুলাইয়ের পর আর কোনো শরণার্থী প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে ৩৩ হাজার ৫৪২ জন নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস করছে। তবে এ সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে ৩৮ হাজার ৪৫৫ জনে দাঁড়িয়েছে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ